বাংলার মেলা কথা: বাঁকুড়া কেঞ্জাকুড়া মুড়ি মেলা

"মেলাকথায়" আজ বন্ধুদের নিয়ে যাব এমন একটা মেলায় যে মেলা একেবারে অভিনব। মেলার নাম "মুড়ি মেলা"। আমাদের এই অপরূপ শস্যশ্যামলা বাংলায় কতই না মেলা বসে। কিন্তু মুড়ি নিয়ে আস্ত একটা মেলার কথা ভাবা যায়! চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই হবে না। আসলে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে যে রোজকার সহজ সরল জীবনের কথা কীভাবে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে শহুরে জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষ অত সহজে তা অনুভব করতে পারবে না।

পাঠক বন্ধুরা নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন? কিন্তু বাঁকুড়ার মানুষের কাছে মুড়ি এতটাই প্রিয় যে কথিত আছে একবার আকাশপথে ঢেঁকিতে চড়ে যাওয়ার সময় স্বয়ং নারদ মুনি মুড়ি ভেজানোর চোঁ চোঁ শব্দে রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তাই বলে শুধু মুড়ি নিয়ে একখানা মেলা! কিন্তু এমন একখানা মেলাই বসে আমাদের এই বঙ্গ দেশের বাঁকুড়া জেলার কেঞ্জাকুড়া-য়। মাঘ মাসের চার তারিখ মানে বাঁকুড়ার দ্বারকেশ্বর নদের চর 'মুড়িময়'। এখানে বসে বিখ্যাত মুড়ি মেলা। বলা যেতে পারে বাঁকুড়াবাসীর মুড়ি প্রীতির সম্মানে দ্বারকেশ্বরের চরে বসে এই মুড়িমেলা।

কেঞ্জাকুড়া গ্রামের এই মুড়ির মেলার বয়স প্রায় দু'শো বছর। কেঞ্জাকুড়া গ্রামের গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে দ্বারকেশ্বর নদ আর এই নদের তীরেই রয়েছে সঞ্জীবনী মাতার মন্দির। সেই মন্দিরে বহু প্রাচীন কাল থেকেই মকর সংক্রান্তির সময় নামসংকীর্তন অনুষ্ঠিত হয় এবং এই উৎসব চলে মাঘ মাসের এক তারিখ থেকে চার তারিখ পর্যন্ত। কথিত আছে একসময় দূর দূরান্তের মানুষ সংকীর্তন শুনতে এই সঞ্জীবনী মাতার আশ্রমে আসতেন। সারা রাত সংকীর্তন শুনে তাঁরা ফিরে যেতেন নিজের নিজের গ্রামে। রাত্রে বা পরদিন কীর্তন শুনে ফেরার পথে খিদে পেলে খাওয়ার জন্য সঙ্গে করে মুড়ি নিয়ে আসতেন কারণ ধু ধু নদীর চরে কোনো খাবার পাওয়া সম্ভব ছিল না। সকালে বাড়িতে ফেরার সময় সেই সঙ্গে আনা মুড়ি দারকেশ্বর নদের চরে বসে খেতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সেই অভ্যাস পরিণত হয়েছে ঐতিহ্যে। এখন প্রতি বছর মাঘ মাসের চার তারিখ দূর দূরান্ত থেকে মানুষ দ্বারকেশ্বরের চরে এসে হাজির হন।

 

Bankura1

 

বাঁকুড়ার অন্ততঃ ৫০-৬০টি গ্রামের মানুষ এ দিন হাজির হন কেঞ্জাকুড়ায়। উপচে পড়া ভিড় বুঝিয়ে দেয় সংখ্যাটা চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজারের বেশিই হবে। সঙ্গে করে নিয়ে আসেন বস্তা ভর্তি মুড়ি। মুড়ির সঙ্গে "টুরি" হিসেবে থাকে চানাচুর, চপ, সিঙ্গারা, বেগুনি, সেদ্ধ আলু, ঘুগনি, শসা, পেঁয়াজ, নারকেল, টমেটো। বাদ থাকে না বিভিন্ন ধরনের নাড়ু, জিলিপি, নানা ধরনের মিষ্টি সহ বিভিন্ন পদও। চরের বালিতে গামছা বিছিয়ে নানা পদের সঙ্গে পাহাড় প্রমাণ মুড়ি নিয়ে মহানন্দে চলতে থাকে "মুড়ি পিকনিক"। নদের বালি সরিয়ে বের করা হয় মিষ্টি জল।

সেই জলেই মুড়ি মেখে চলে দিব্যি খাওয়াদাওয়া। শীতের সোনালি রোদ গায়ে মাখতে মাখতে নদীর চরে বসে পরিবারের লোকজন অতি আহ্লাদের সঙ্গে একসঙ্গে মুড়ি খান। সঙ্গে চলে আড্ডা, হৈ হুল্লোড়। এটাই মুড়ি মেলা। এই দিনটার জন্য এলাকাবাসীরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন। এই দিন মুড়ি খাওয়ার পাশাপাশি পরিবারের সকলে মিলে গল্পের আসর বসে। বাইরে থেকে গ্রামে আত্মীয়স্বজনরাও আসেন এই সময়। এই মিলনমেলায় কত সময় দেখা হয়ে যায় কত পরিচিতজন বা পুরনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে। গ্রামবাসীরা নতুন জামকাপড় পর্যন্ত কেনেন এই মেলায় পরে আসার জন্য। দুই শত বছরের বেশি প্রাচীন মুড়ি মেলার আড়ম্বর বেড়েছে ছাড়া কমেনি।

মেলায় হাজির হওয়া গ্রামবাসীদের জন্য এ দিন দুপুরে খিচুড়ি প্রসাদের ও ব্যবস্থা থাকে সঞ্জীবনী মাতার আশ্রমে। দ্বারকেশ্বরে স্নান সেরে নদের চরে দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষজন খিচুড়ি প্রসাদ গ্রহন করেন। পাশাপাশি মুড়ি উৎসব চলে গোটা দিন ধরে। আনন্দে ভরপুর মনে ফের একটা বছরের অপেক্ষা নিয়ে দিন শেষে নিজের নিজের ঘরের পথে পা বাড়ান গাঁয়ের মানুষ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...