বাংলার মেলা কথা: বক্রেশ্বর মহাশিবরাত্রি মেলা

মেলা, এই ছোট্ট একটি শব্দের ব্যাপ্তী কিন্তু অনেক বড়ো। মেলা অর্থ মিলন। যেখানে বহু মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে নিজেদের আনন্দ একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নেবেন তাইই হলো মেলা। "বাংলার মেলা কথা" সিরিজে প্রতি পর্বে এই নিবন্ধকার পাঠকদের নিয়ে যান এই সোনার বাংলায় বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন উপলক্ষে আয়োজিত মেলায়। নিয়ে যাওয়া অর্থাৎ এই নিবন্ধটি পাঠের মধ্যে দিয়ে যেন তাঁরা মানস চোখে মেলাগুলি দেখতে পারেন, সেগুলির ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হতে পারেন।

সামনেই আসছে মহাশিবরাত্রি। হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র একটি দিন। ঐ দিনটিকে ঘিরে চলে উপবাস, পূজা, নানাবিধ উৎসব, এবং মেলা। শিবরাত্রি উপলক্ষে বাংলার বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়। আজ, এই নিবন্ধ-লেখিকা পাঠকবন্ধুদের নিয়ে যাবেন শৈবতীর্থ বক্রেশ্বরে শিবরাত্রির মেলায়

মহাশিবরাত্রি বা শিবরাত্রি হিন্দু শৈব সম্প্রদায়ের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথিতে পালিত হয় এই মহাশিবরাত্রি। শিবরাত্রি হল দেবাদিদেব মহেশ্বর 'শিবের মহা রাত্রি'। ভক্ত মানুষদের বিশ্বাস এই ব্রত পালন করলে অন্ধকার আর অজ্ঞতা দূর হয়।

 

bakreswar1

 

'শিবরাত্রি' কথাটা দুটি শব্দ দিয়ে তৈরি। 'শিব''রাত্রি', যার অর্থ শিবের জন্য যে রাত। এই মহাশিবরাত্রি নিয়ে নানান কাহিনী প্রচলিত আছে।

একটি উপাখ্যান অনুযায়ী দেবী পার্বতীর সঙ্গে এদিন দেবাদিদেব মহাদেবের মিলন হয়। আবার এটাও ভক্তজনের বিশ্বাস যে এদিন থেকেই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছিল।

শিবরাত্রির ব্রতকথার কাহিনি এরকম, এক শিকারি একদিন বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে কোনও শিকার পায় নি। সারাদিন কোনো খাওয়া জোটে না তার। দিন শেষ হয়ে যাওয়ায় ক্লান্ত হয়ে একটি বেলগাছের ডালে আশ্রয় নিয়েছিল সে। অন্যমনস্ক, শ্রান্ত ব্যাধ বেলপাতা ছিঁড়ে নীচে ফেলতে থাকে। সেই গাছটির নীচেই ছিল একটি শিবলিঙ্গ। মহাদেব হলেন আশুতোষ অর্থাৎ সামান্যতেই তুষ্ট হন। সেই বেলপাতায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব ব্যাধকে আশীর্বাদ করেন এবং তার সমস্ত দুঃখ দূর হয়ে যায়।

সেই তিথিটি ছিল ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী। তখন থেকেই প্রচলিত হয় যে ঐ তিথিতে উপবাস করে শিবের মাথায় জল এবং বেলপাতা দিলে মহাদেব তুষ্ট হন এবং ভক্তের মনবাসনা পূর্ণ করেন।

মহাশিবরাত্রিতে মূলত স্বামী-সন্তানের মঙ্গল কামনায় বিবাহিতা মহিলারা উপবাস করে শিবের আরাধনা করে থাকেন এবং অবিবাহিতা মেয়েরা শিবের মতো বর পাবে- এই বিশ্বাস থেকে শিবের মাথায় জল ঢালে। তবে শুধু মহিলারা নয়, অনেক পুরুষও নিষ্ঠা ভরে এই ব্রত পালন করেন।

 

bakreswar2

 

দেবদেবীদের স্থান বা পীঠ হিসাবে বিশেষ খ্যাতি রয়েছে বীরভূম জেলার। এই জেলাতে রয়েছে বেশ কয়েকটি বিখ্যাত শৈবধাম। বক্রেশ্বর এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত। বক্রেশ্বর মন্দির বা মন্দিরের দেবতা বক্রেশ্বর মহাদেবকে ঘিরে প্রায় সারা বছরই হয়ে থাকে নানা উৎসব অনুষ্ঠান। তবে এই শৈবতীর্থ সব থেকে বেশি মানুষের ভিড়ে জমজমাট হয়ে ওঠে শিবচতুর্দশী বা শিবরাত্রির সময়।

বীরভূম জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান বক্রেশ্বর। শিবরাত্রি উপলক্ষে সবচেয়ে বড় মেলাটি হয় বক্রেশ্বরেই। অন্তত আট দিন ধরে এই মেলা চলে। এর প্রধান কারণ কিন্তু স্থানটির দেব মাহাত্ম্য। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে এই মাহাত্ম্যের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। ঋষি অষ্টাবক্রের নামেই এই পীঠস্থানের নাম বক্রেশ্বর - এই একটা বিষয়ে সবাই একমত।

কাহিনী সংক্ষেপ- এক সকালে নিজের আশ্রমে বসে ঋষিবালকদের পাঠ দিচ্ছিলেন কাহোড় মুনি। পাশেই বসেছিলেন তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী সুজাতা। পাঠদানের সময় হঠাৎই দেখলেন স্ত্রী সুজাতা কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ করছে। তা দেখে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ মুনিবর এই আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করলে সুজাতা উত্তরে স্বামী কাহোড় মুনিকে বললেন, 'প্রভু আমাদের গর্ভের সন্তান বলতে চাইছে, আপনার পাঠদানে কিছু ভুল রয়েছে'। শিষ্য বিদ্যার্থী আশ্রমবালকদের সামনে গর্ভস্থ সন্তানের এমন আচরণে প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত কাহোড় মুনি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নিজের অনাগত সন্তানকে অভিশাপ দিলেন, এই শিশু জন্মলাভ করবে অষ্টঅঙ্গের বিকৃতি নিয়ে।

সেই অভিশাপের জেরেই আটটি বাঁকা অঙ্গ নিয়ে তাঁর এক পুত্র জন্ম নিল। আট অঙ্গ বাঁকা, তাই তাঁর নাম হল "অষ্টাবক্র''। এই অষ্টাবক্র ছিলেন অতি জ্ঞানী। নিজের অঙ্গ বিকৃতি দূর করার নিমিত্ত তিনি মহাদেবকে তুষ্ট করার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। ষাট হাজার বছর তপস্যা করার পরে তুষ্ট হয়ে মহাদেব অষ্টাবক্রকে দেখা দিলেন এবং অষ্টাবক্রের স্বাভাবিক দেহ ফিরিয়ে দিলেন। অষ্টাবক্র মুনীর আরাধ্য মহাদেব, তাই মহাদেবের নাম হল বক্রেশ্বর অষ্টাবক্রের এই তপস্যাস্থলেরও নাম হল বক্রেশ্বর।

 

bakreswar3

 

এক সময় এই বক্রেশ্বর ছিল গভীর জঙ্গলে ঢাকা। ধীরে ধীরে জনবসতি গড়ে ওঠে। মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয় দেবমাহাত্ম্য। দেবস্থানকে ঘিরে শুরু হয় নানা উৎসব অনুষ্ঠান। এ সব উৎসবের মধ্যেই আসে শিবচতুর্দশী বা শিবরাত্রি। সাধারণের বিশ্বাস, এই দিনেই শিব-পার্বতীর বিয়ে হয়। ভিড় বাড়তে থাকে এই দেবস্থানে। এই ভিড় এক সময় মেলার রূপ নেয়। এ ভাবেই বক্রেশ্বর শিবরাত্রি মেলার সূচনা হয়।

মেলার শুরুর দিকে রাস্তাঘাট বা যানবাহনের বিশেষ ভালো ব্যবস্থা ছিল না। দূরদূরান্তের মানুষ আসতেন হেঁটে অথবা গোরুর গাড়ি চেপে। গ্রামীণ মানুষ সারা বছরের ঘর গেরস্থালির প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, চাষবাসের সরঞ্জাম কেনাকাটা করতেন এই মেলা থেকে। দিনে দিনে মেলা আরো বড় আকার নিয়েছে। রকমারী বিনোদনের আয়োজনও হয়েছে এই মেলায়। সার্কাস, সিনেমা, ম্যাজিক, চিড়িয়াখানা, পুতুলনাচ, মরণকুয়ো, নাগরদোলা, মৎস্যকন্যা, কথা বলা পুতুল ইত্যাদি। এখনকার বাসস্ট্যান্ড থেকে মূল মন্দির পর্যন্ত প্রায় চারশো মিটার রাস্তার দু'পাশে সার দিয়ে বসে মেলার দোকানপাট।

স্থানীয় ভাষায় এক একটা পসরার (বিক্রয়দ্রব্য) পরপর সাজিয়ে দোকান বসানোকে বলা হয় পটি। কাপড়ের পটি, জুতোর পটি, মনোহারির পটি, কলার পটি, লোহার পটির মত বিভিন্ন পটিতে ব্যবসায়ীরা সাজিয়ে তোলেন এই মেলাকে। রঙিন সরবত, রঙবেরঙের পানমশলায় সাজানো পানের দোকান, বাঁশি, পুতুল আর বেলুনের চলমান বিপণিগুলো মেলার অন্যতম আকষর্ণ। কী পাওয়া যায় না এই মেলায়! মাছ ধরার জাল, চাষবাসের যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে শিল, নোড়া, পাথরবাটি, ঝুড়ি, ঘণ্টা, শাঁখ, পূজার তৈজসপত্র, রান্নার বাসন পত্র- এক কথায় দৈনন্দিন ব্যবহারের সমস্ত জিনিস। থাকে বইয়ের দোকানও।

বর্তমানে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে বক্রেশ্বর তীর্থক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য গঠিত হয়েছে 'বক্রেশ্বর উন্নয়ন পর্ষদ'। মেলা উপলক্ষে আসা পুণ্যার্থীদের সুযোগ সুবিধার নানা ব্যবস্থা করার পাশাপাশি সেই মেলা বসার জায়গাটিতেও ব্যবসায়ীদের জন্য নানান ব্যবস্থা করা হয়। সব মিলিয়ে জমজমাট হয়ে উঠবে এ বারের শিবরাত্রি মেলাও, এমনই আশা করেন পূজা দিতে আসা ভক্ত থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শনার্থী, ক্রেতা, বিক্রেতারা। পাঠকবন্ধুদের সবাইকে আগত মহাশিবরাত্রির শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করা যাক এই মেলা পর্ব। সবাই সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...