চলুন একটু ঘুরে আসা যাক মাস দুয়েক আগে নদীয়া জেলা থেকে। অসুবিধা কোথায়? এইই আপনারা গুপি গাইন বাঘা বাইন এর জুতো পায়ে গলালেন, এই আমার হাতে তালি দিলেন আর... ব্যস্ পৌঁছে গেলাম আমরা চৈত্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে কৃষ্ণনগরে। হ্যাঁ পাঠক বন্ধুরা, নদীয়া জেলার সদর শহর মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নামে বিখ্যাত সেই কৃষ্ণনগরে। কেন এসেছি তাও জানেন না? আরে আমরা তো মেলা দেখতে এসেছি। কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত বারোদোলের (বারদোল বা বারোদল নামেও অভিহিত হয়) মেলা। যেই মেলা শুরু করেছিলেন স্বয়ং মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র।
যে কোনো মেলায় আমরা তো জানি মানুষে মানুষে মিলন হয়। মানুষের সঙ্গে দেবতাদেরও মিলমিশ হয়। কিন্তু দেবতাদের নিজেদের মধ্যে রিইউনিয়ন বা পুনর্মিলনী উৎসবের কথা শুনেছেন কি? এই কৃষ্ণনগর বারদোল মেলায় দেবতাদের নিজেদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ ঘটে। তাঁরা হয়তো নিজেদের মধ্যে কুশলবিনিময় করেন। সেটা বৈকুণ্ঠের কোনো ভাষা হবে... অথবা সংস্কৃত। কিংবা ব্রজবুলি। মোটকথা আমি সে ভাষা জানিও না শুনিওনি। যাই হোক, মেলায় বেড়াতে এসে এত কিছু জানার দরকারটাই বা কী! আমরা বরং মেলার ইতিহাসে ফিরি আর মেলায় ঘুরে বেড়াই।
বাংলার প্রাচীন এবং বৃহত্তম মেলাগুলির মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হলো কৃষ্ণনগরের এই বারোদোল মেলা। আড়াইশো বছরের পুরনো এই ঐতিহাসিক মেলা বসে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির গড়ে। এই মেলা নিয়ে একটি জনশ্রুতি চালু রয়েছে। সেটা বরং বলা যাক। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র দ্বিতীয় বার বিবাহ করেছিলেন রানাঘাটের এক ব্রাহ্মণের কন্যা লক্ষ্মী দেবীকে। অনিন্দ্যসুন্দরী সুলক্ষণা সেই কন্যা কিন্তু কোনো রাজপরিবার বা জমিদার পরিবারের ছিলেন না।
এখন তিনি তো রানী হয়ে এলেন কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে। এখানে তো হাজার রকমের নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতে হয় তাঁকে। কিন্তু তিনি সাধারণ পরিবারের কন্যা। ছটফটে হাসিখুশি কিশোরী মেয়েদের মতোই তাঁর ভালো লাগে মেলায় বেড়াতে যেতে। সেখান থেকে পুতুল কিনতে, বাদাম ভাজা কিনে খেতে।
অথচ রাজবাড়ির বধূরা সাধারণ মানুষের মতো যেখানে সেখানে যেতে পারেন না। তাই তাঁর ভারী মনখারাপ হয়। তিনি শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ান। রানীর মনখারাপের কারণ শুনে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রও দুঃখিত হন। প্রথমে তিনি রানী মাকে কথা দেন তিনি নিজে লক্ষ্মী দেবীকে মেলা দেখতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু কাজের চাপে সে ও আর হয়ে ওঠেনা।
তখন তিনি ভাবলেন "রাজবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে একটা মেলা শুরু করলে কেমন হয়? তাহলে রানীকে আর দূরে কোথাও মেলা দেখতে যেতে হবে না। মেলাকেই মহারানীর কাছে হাজির করা যাবে"... এখন মেলা শুরু করার জন্য তো কোনো কার্যকারণ চাই। তিনি ভাবলেন দোল উপলক্ষে একটি মেলার আয়োজন করবেন।
কিন্তু সেটা তো চৈত্র মাস। ফাল্গুন মাসে তো দোল উৎসব হয়ে গেছে। তিনি তখন বড়ো বড়ো পণ্ডিতদের ডাকলেন। তাঁদের বিধান জানতে চাইলেন। পাঁজি পুঁথি ঘেঁটে পণ্ডিতরা বিধান দিলেন যে একটা নতুন ধরনের "দোল উৎসব" করা যেতে পারে। "হরিভক্তিবিলাস" গ্ৰন্থে লেখা আছে যে চৈত্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে নৃত্যগীতাদি সহযোগে দেবদেবীদের দক্ষিণ মুখ করে একমাস দোলায় বসিয়ে দোলাতে হয়।
ব্যস্, সব সমস্যার সমাধান। এই দোলের বিধান রাজার মনকেও দুলিয়ে গেল। রংদোল নয় অথচ দোল। এবার এই বাহিরদোল উৎসবকে কেন্দ্র করেই একমাসের মেলা শুরু হয়ে গেল রাজবাড়ির ঠিক বাইরেই। গড়ের ভিতরে, বাংলার বৃহত্তম নাটমন্দির আর নহবতখানাকে সাক্ষি রেখে শুরু হলো "বাহিরদোলের মেলা" লোকমুখে যা দাঁড়ায় " বারোদোলের মেলা"। মহারানীর আর মেলায় বেড়াতে যাওয়ার অসুবিধা রইলো না।
এই মেলা মোটামুটি ভাবে ১৭৫২ থেকে ১৭৫৬র মধ্যে প্রবর্তিত হয়। এই মেলা প্রবর্তনের পিছনে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অন্য উদ্দেশ্য ও ছিল। তিনি নিজে ছিলেন শাক্ত। তাই রাজবাড়িতেও জাঁকজমক সহকারে দুর্গা পূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা করতেন। এ নিয়ে নদীয়ার বৈষ্ণবদের মনে কিছুটা ক্ষোভ ছিল যে মহারাজ ভগবানবিষ্ণু বা গোপালকে ততটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
কৃষ্ণচন্দ্র ভাবলেন যে এই বাহিরদোল উপলক্ষে যদি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-গোপাল বা নারায়ণকে নিয়ে যদি একটা বড়ো উৎসব শুরু করা যায় তাহলে বৈষ্ণবদের মনেও আর কোনো ক্ষোভ থাকবে না। তিনি বৈষ্ণবদের দেখিয়ে দিতে পারবেন যে শাক্তরা শুধু নয়, বৈষ্ণবরাও তাঁর অত্যন্ত কাছের। এই দুই ভাবনা থেকেই শুরু বারদোল উৎসব এবং মেলা।
বারোদলে মিলিত হন তেরো জন দেবতা। প্রত্যেকেই নারায়ণের এক একটি রূপ। তাঁরা হলেন বিরহীর বলরাম, শ্রীগোপীমোহন, মদনগোপাল, বহিরগাছির লক্ষ্মীকান্ত, নবদ্বীপের নদের গোপাল, শান্তিপুরের গড়ের গোপাল, অগ্ৰদ্বীপের গোপিনাথ, তেহট্টের কৃষ্ণরায়, রাজবাড়ির নারায়ণচন্দ্র, ছোট নারায়ণ, বড় নারায়ণ, ব্রহ্মণ্যদেব এবং গোবিন্দদেব... এই তেরো দেবের মিলন ঘটে এই বারোদলে।
এই মহামিলনের জৌলুস দেখবার মতো। মেলা শুরুর দিনে বিগ্ৰহগুলিকে সোনার অলঙ্কারের "রাজবেশ", দ্বিতীয় দিনে সুগন্ধি ফুলের গয়নায় "ফুল বেশ" এবং তৃতীয় দিনে লাঠি হাতে "রাখাল বেশে" সাজানো হয়। মহা সমারোহে উৎসব ও মেলা জমে ওঠে।
বর্তমানে কালের প্রভাবে মেলার সমারোহ একটু কমলেও প্রায় তিন সপ্তাহ চলে এই মেলা। পাওয়া যায় গৃহস্থালীর সামগ্ৰী থেকে কৃষ্ণনগরের সরভাজা। বিক্রি হয় কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত মাটির পুতুল। গয়নার আকর্ষণও কম নয়। ঢাকাই পরোটার সঙ্গে দেদার বিকোয় পাঁপড়ভাজা, মিষ্টি, পাপড়িচাট।
এই দোলে রঙ খেলার চল নেই। বিগ্ৰহের পায়ে সামান্য আবীর মাখিয়ে দেন ভক্তরা। তবে আবীর দিয়ে রঙখেলা না থাকলেও মেলায় মানুষের মন কিন্তু রঙিন হয়ে ওঠেই।
আজকের মেলায় বেড়ানো শেষ করি? পাঠক বন্ধুরা, সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। আরো নতুন নতুন মেলায় যেতে হবে না?