মেলায় মেলায় বেড়াতে মন্দ লাগে না বলুন? কত রকমের উৎসব, কত রকমের মানুষ। আমাদের এই সুন্দরী বাংলায় কি আর পার্বণের অভাব আছে? বারো মাসে তেরো নয়, বরং তেরো বারো একশো ছাপ্পান্ন খানা পালা পার্বণ চলতেই থাকে সারা বছর ধরে। আর এইসব ধর্মীয় পালা পার্বণের হাত ধরেই আসে কত রকমের মেলা।
আমরা এ পর্যন্ত যতগুলো মেলায় ঘুরলাম সেগুলো সবই দক্ষিণ বঙ্গের মেলা। এবার চলুন না একটু উত্তরবঙ্গের দিকে পা বাড়াই। যদিও এই মেলাটি বসে শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে অর্থাৎ মোটামুটি আবার সামনের বছর ফাল্গুন মাসে বসবে কিন্তু আমরা তো মনে মনে হারিয়ে যেতে পারি তাই না? ..."মেলে দিলেম গানের সুরে এই ডানা মনে মনে".... তো চলুন যাওয়া যাক উত্তরবঙ্গ।
এই তো পৌঁছে গিয়েছি আমরা জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি... উত্তরবঙ্গের একটি ভারি সুন্দর জনপদ। ময়নাগুড়ির একদিকে তিস্তা নদী আর অন্য দিকে জলঢাকা নদী। একপাশে গরুমারা অরণ্য। এরকম একটা চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর জায়গায় জরদা নদীর ধারে রয়েছে জল্পেশ মন্দির, উত্তর পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রধান ঐতিহ্যমন্ডিত শৈব তীর্থ। আর এই অতি প্রাচীন শিবমন্দিরে শিবরাত্রির শিবপুজো উপলক্ষ্যেই এই এলাকায় বসে জল্পেশের মেলা।
গবেষকদের মতে এই মন্দির হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। পুরাণ মতে প্রাচীন প্রাগজ্যোতিষপুর (বর্তমান অসম) এর এক রাজা এই মন্দির স্থাপন করেছিলেন। এই রাজার নাম ছিল জল্পেশ এবং তাঁর নামেই এই শিবলিঙ্গের নাম হয় জল্পেশ শিব। যদিও এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে পুরনো মন্দিরটি একসময় ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল।
সপ্তদশ শতাব্দীতে কোচবিহারের মহারাজা প্রাণনারায়ণ এবং তাঁর পুত্র মহারাজা মোদনারায়ণ এই মন্দিরটির সংস্কার করেন এবং সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে এখানে মেলা শুরু হয়। একদল ইতিহাসবিদদের মতে মুসলমান স্থপতিরা এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন তাই এই মন্দিরের চূড়া গম্বুজাকৃতি।
প্রায় এক একর জমিতে গড়ে ওঠা এই মন্দিরটির উচ্চতা ১২৭ ফুট। মন্দির চত্বরে সুবর্ণকুণ্ড নামে একটি বিরাট জলাশয় রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমৃদ্ধ এই মন্দিরটি দেখতে এবং পুজো দিতে দেশ বিদেশ থেকে বহু দর্শনার্থী আসেন। এই মন্দিরে শিব অনাদি অর্থাৎ স্বয়ম্ভূ। শিবলিঙ্গের বেশিরভাগ অংশ জলের তলায় থাকে। সবথেকে সাদা রঙের শিবলিঙ্গের খুব কম অংশই চোখে দেখা যায়।
শিবরাত্রির দিন লক্ষ লক্ষ ভক্ত এই মন্দিরে শিবের মাথায় জল ঢালেন। শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে মন্দিরটিকেও সাজিয়ে তোলা হয়। পুণ্যার্থীরা শিবপুজো করেন, সঙ্গে দেবী ভ্রামরীকেও দর্শন করেন। এছাড়া ও এই মন্দিরে নারায়ণ এবং মা কালীরও মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের পাশে দু কিলোমিটার জায়গা জুড়ে মেলা বসে। দেব দর্শনের পাশাপাশি ভক্তরা মেলায় বেড়িয়েও প্রভূত আনন্দ লাভ করেন। শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, ভুটান থেকেও প্রচুর ব্যবসায়ী আসেন এই মেলায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। দশ দিন ধরে চলে দেব জল্পেশের মেলা।
পাঠক বন্ধুরা, ভাল লাগল জল্পেশের মেলায় ঘুরে? আমার সঙ্গে তো মানস ভ্রমণ হয়ে গেল, সত্যিকারের জল্পেশের মেলা দেখতে পরের বছর শিবরাত্রিতে রওনা দিলেই হয় মহা পূণ্যভূমি জল্পেশ মন্দিরের উদ্দেশ্যে।