বাংলার মেলা কথা: জানবাজারের রানী রাসমণির রথযাত্রা উৎসব

রথের দড়ি ধরে টানলেই পুণ্য লাভ হবে, ধুয়ে মুছে যাবে সব পাপ-এই চিরকালীন বিশ্বাস থেকেই ভক্ত মানুষরা পুরী থেকে বাংলার - বিভিন্ন রথযাত্রার উৎসবে সামিল হন। বহু প্রাচীন কাল থেকেই রথ বাঙালি সংস্কৃতির সাথে আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে। রথযাত্রা উপলক্ষে বসে যে রথের মেলা তা নিয়ে লেখা হয়েছে কত কবিতা, গল্প।

তবে রথযাত্রার ধূমধাম আগের মতো না থাকলেও এই উৎসবের আমেজ কিন্তু কমে নি আজও। সেজন্য, গত চার সপ্তাহ জুড়ে "বাংলার মেলা কথার" পাঠকবন্ধুদের এই বাংলারই বিখ্যাত চারটি রথের মেলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যদিও সেগুলো মনে মনে বেড়ানো। তা হলোই না হয় মনে মনে, কিন্তু মনের চোখ দিয়ে দেখা... তার মূল্য কিছু কম নাকি? কিন্তু এবছরের মতো রথযাত্রা উৎসব তো শেষ। না না, উল্টোরথ এখনও বাকি। তাই আরেকটা রথ পর্ব আপনাদের জন্য নিয়ে আসা যাক।

গত চারটি মেলা পর্বে যে রথযাত্রাগুলোর কথা বলা হয়েছিল সেই বিখ্যাত উৎসবগুলো সবকটাই কলকাতার বাইরে.... অন্যান্য জেলায়। কিন্তু কলকাতা হলো পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। রথযাত্রার কথা বলতে গিয়ে এই কল্লোলিনী তিলোত্তমাকে বাদ দিলে কি হয়? সে দুঃখ পাবে না? এই শহরের রথযাত্রার ইতিহাস কিন্তু যথেষ্ট সমৃদ্ধ। বেশ কয়েকটি রথযাত্রার বয়স প্রায় তিনশো বছরের কাছাকাছি। আজ সেই ঐতিহ্যবাহী রথ উৎসবগুলোর মধ্যে বিশেষ একটির ইতিহাস আপনাদের কাছে একটু তুলে ধরা যাক। এই রথ হলো জানবাজারের জমিদারবাড়ির রথ।

জানবাজারের জমিদারবাড়ি বললেই যার নাম সবার প্রথমে মনে পড়ে তিনি হলেন রানী রাসমণি যার সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছিলেন, '‘রানী রাসমণি শ্রীশ্রীজগদীশ্বরীর অষ্টসখীর একজন। ধরাধামে জগদম্বার পূজা প্রচারের জন্যই আসিয়াছিলেন।'’ জানবাজার জমিদারবাড়ির রথযাত্রা উৎসব এই মহীয়সী নারীই শুরু করেছিলেন।

রানী রাসমণি শক্তি আরাধনা করলেও পিতৃসূত্রে তিনি বৈষ্ণবভাবাপন্ন ছিলেন এবং তাঁর শ্বশুরালয়েও শ্রী‘রঘুনাথজিউ’ গৃহদেবতা রূপে প্রতিষ্ঠিত হন। তাঁর জানবাজারের বাড়িতে দুর্গাপূজা বা দোল উৎসব মহা সমারোহে পালিত হলেও রথযাত্রা উপলক্ষে কোনো উৎসব অনুষ্ঠান হতো না। জানবাজারের জমিদার বাড়ির তখন বাংলাজোড়া নাম-যশ-খ্যাতি ৷ বাংলার প্রায় সর্বত্র ছড়িয়েছিল তাঁদের জমিদারি ৷

Janbajar1

রানি রাসমণির স্বামী রাজচন্দ্র দাসের মৃত্যুর পর তাঁর বিশাল জমিদারি এবং ব্যবসার দায়িত্ব এসে পড়ল রাসমণির উপর ৷ স্বামীর সুযোগ্য সহধর্মিনী ছিলেন তিনি ৷ নিজের তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং দূরদর্শিতা কাজে লাগিয়ে সেই সম্পত্তি বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছিলেন। পাশাপাশি তিনি অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ ছিলেন। দান ধ্যানের শেষ ছিল না তাঁর। ধর্মীয় উৎসবগুলিও খুব জাঁকজমক সহকারে পালন করতেন। তাঁর রাজসিক মানসিকতার প্রকাশ ঘটত বড় বড় উৎসবে ৷ শহরের মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে যেত সেই উৎসব চাক্ষুষ করে ৷ তাঁর কথা ছিল, যা হবে কখনও ছোটখাটো হবে না ৷ সকলকে নিয়ে উৎসব ৷ সবাই সেই উৎসবের আনন্দের অংশীদার হবে।

স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর একবার ইচ্ছে হলো রথে আরোহণ করিয়ে প্রভু রঘুনাথ জিউকে কলকাতার রাজপথে ভ্রমণ করাবেন ৷ তা আবার এমনি কোনো সাধারণ কাঠের রথে নয়, ঝকঝকে রুপোর রথে বসিয়ে ৷ তাঁর জামাতা মথুরামোহন চেয়েছিলেন বিখ্যাত সাহেব জহুরী হ্যামিলটন কোম্পানিতে অর্ডার দিয়ে রথটি তৈরি করাতে।

কিন্তু রানী মা'র বড় জামাতা রামচন্দ্র দাস পরামর্শ দিলেন দেশি কারিগর থাকতে বিদেশির কাছে যাবেন কেন? দেশের শিল্পী বা কারিগরদের দিয়ে বানালে দেশীয় মানুষদেরই উপকার করা হবে। দেশীয় কারিগররা পারিশ্রমিক পেলে তাদের অভাব কিছুটা হলেও কমবে, এবং কাজেও তাদের আরও উৎসাহ বাড়বে। সেই পরামর্শ মতোই সিঁথি, ভবানীপুর প্রভৃতি জায়গা থেকে বাছাই করা কারিগরদের এনে নিজেদের বাড়িতে রেখে যোগ্য পারিশ্রমিক দিয়ে রথ বানানোর কাজ শুরু হলো।

দিনরাত পরিশ্রম করে সেই দক্ষ কারিগররা আষাঢ় মাসে রথযাত্রা তিথির আগেই রথ তৈরির কাজ শেষ করে ফেললেন। রথটি রূপোর হলেও রথের চারটি চাকা কিন্তু ছিল কাঠের। এর সঠিক কারণ জানা যায়নি। অনুমান করা যেতে পারে পুরীর রথের চাকা যেহেতু কাঠ দিয়ে তৈরি হয় তাই হয়তো রানী রাসমণি তাঁর রথের চাকাও কাঠ দিয়ে বানানোর হুকুম দিয়েছিলেন।

১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে শুরু হল রাসমণি দেবীর এই রূপার রথের যাত্রা। রথের জন্য তখনকার হিসেবে প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল। এই রথে কিন্তু জগন্নাথ দেব অধিষ্ঠিত হন নি। রথে গৃহদেবতা রঘুনাথ জীউকে বসিয়ে নিজের মনের একান্ত ইচ্ছে পূরণ করেছিলেন রানী রাসমণি। রথযাত্রার পুণ্য তিথিতে শুরু হল রানী রাসমণির রথের যাত্রা । যতদিন রানীমা বেঁচে ছিলেন, ধূমধাম করে, মহা জাঁকজমক সহকারে রানী মা'র রথযাত্রা উৎসব পালিত হতো।

রথযাত্রার সময় ঢাক, ঢোল, সানাই, বাঁশি, জগঝম্প প্রভৃতি নানান বাজনা আনা হতো। বাজনা ও কীর্তনের দল রথের পেছনে পেছনে যেত। গোরুর গাড়িতে রৌশনচৌকি, সানাই, ঢাক, ঢোল, নাকাড়া ইত্যাদি নিয়ে একশোরও বেশি বাদ্যকর শব্দে মুখরিত করত চারিদিক। রথের সামনে হাঁটতেন রানী মা'র জামাইরা এবং জমিদার বাড়ির অন্যান্য পুরুষ সদস্যরা। তারা বহুমূল্য নতুন বস্ত্র পরিধান করলেও পা কিন্তু খালি থাকত।

Janbajar2

রথযাত্রা উপলক্ষে প্রতিবছর ২ থেকে ৩মণ যুঁই ফুলের মালা কেনা হতো। দলে দলে মানুষ আসতেন ‘রানীর রথ’ দেখতে। সেই যুগের নামকরা বাউলের দল, যাত্রার দল, বালক সঙ্গীতের দল, সঙ্কীর্তন সম্প্রদায়, নানারকম রঙ তামাসা, বাগবাজারের সখের নামগান, নামজাদা দোহাররা আসতেন রানী রাসমণির এই রথযাত্রায়। প্রায় পাঁচশো লোক রথের দড়ি ধরে রথ টেনে নিয়ে যেত এবং রথে অধিষ্ঠিত থাকতেন শ্রীশ্রীরঘুনাথ জীউ।

সেই যুগেই রানী রাসমণি দেবীর রথযাত্রা উপলক্ষে প্রায় দশহাজার টাকা খরচ হতো। এই রথযাত্রা উপলক্ষে তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে তাঁর বাড়িতে নিয়ে আসতেন। একবার তিনি এই উৎসব দেখার জন্য সাহেবদেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এই জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব দেখে তারা বলেছিলেন..... '‘Our eyes never met such a gorgeous, pompous extraordinary Occasion like this"…. প্রচুর দানধ্যান করতেন এই সময়ে। মেলা তো অবশ্যই বসতো রথযাত্রা ঘিরে। উল্লেখ্য, রাসমণি দেবীর দেহত্যাগের বেশ কিছুদিন পর এই রথটি এবং তাঁর গৃহদেবতা রঘুনাথ জিউকে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে এনে রাখা হয়।

আজও সেই প্রাচীন ঐতিহ্য ও রীতিনীতি মেনে মহাসমারোহে রথযাত্রা উৎসব হয় দক্ষিণেশ্বরের দেবী ভবতারিণীর মন্দিরে। কিন্তু বর্তমানে সেই রথে আসীন হন শ্রী জগন্নাথ দেব। রথের দিন এবং উল্টোরথের দিন পুরো দক্ষিণেশ্বর পরিক্রমা করে রানী রাসমণির রথ। আভিজাত্যে, ঐতিহ্যে, আজও মোহময় এই রথযাত্রা।

রথযাত্রা পর্ব এবার শেষ হোক.. আবার নতুন কোনো মেলায় দেখা হবে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...