বাংলার মেলা: ক্ষীরগ্ৰামের সতীপীঠে দেবী যোগাদ্যার পুজো উপলক্ষ্যে মেলা

গরমকাল তো এসে পড়ল। তাতে কী? আমরা কি মেলায় ডানা মেলে উড়ে যাওয়া বন্ধ করব? কখনোই নয়। গরমকে "ডোন্ট পরোয়া" করেই আমরা হৈ হৈ করে নতুন নতুন মেলায় মিলিত হব। কবি অমিয় চক্রবর্তী তো লিখেই গেছেন ....
"জীবন, জীবন মোহ
ভাষাহারা বুকে স্বপ্নের বিদ্রোহ
মেলাবেন, তিনি মেলাবেন"...
(সংগতি, কবি অমিয় চক্রবর্তী)

তাই, জীবনের মোহে নিজেদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে জীবনের টানে, মানুষের টানে আমরা মেলায় মেলায় মিলবই।

এবারে আমরা যাব পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট থানার অন্তর্গত ক্ষীরগ্রাম। এই ক্ষীরগ্ৰামের পৌরাণিক গুরুত্ব কিন্তু কম নয়। পুরাণ মতে ক্ষীরগ্রাম একটি সতীপীঠ।

পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী দক্ষযজ্ঞের সময় পিতা দক্ষের মুখে স্বামী মহাদেবের নিন্দা সইতে না পেরে সতী দেহত্যাগ করলে মহাদেব তাঁর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য করতে থাকেন, তখন বিষ্ণু সতীর দেহ সুদর্শন চক্র দিয়ে একান্ন খন্ডে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলেন৷ সতীর মৃতদেহের খন্ডাংশ একান্নটি স্থানে পতিত হয়েছিল।

Jogaddya-Fair1

এই একান্নটি স্থান দেবীর পীঠস্থান বা একান্ন পীঠ নামে পরিচিত। বর্ধমানের ক্ষীরগ্রামও এক সতীপীঠ, দেবীর ডান পায়ের আঙুল পড়েছিল এখানে। এখানে দেবী "যোগাদ্যা" নামে পরিচিত। দেবী যোগাদ্যার ভৈরব হলেন ক্ষীরকন্ঠ মহাদেব। এই ক্ষীরকন্ঠ মহাদেবের নামেই এই গ্ৰামের নাম হয়েছিল ক্ষীরগ্ৰাম।

প্রত্যেক বছর বৈশাখ মাসের সংক্রান্তির দিন দেবী যোগাদ্যার পূজা আরাধনা করা হয় আর এই পুজো উপলক্ষ্যেই এখানে বিরাট মেলা বসে। দেবী যোগাদ্যার এই ক্ষীরগ্ৰামে প্রতিষ্ঠিত হওয়া নিয়ে নানান কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। এই ক্ষীরগ্রামে একটা সময় বেশ কিছু চতুষ্পাঠী ছিল।

এখানে পাওয়া গিয়েছে অন্ততঃ চল্লিশটি প্রাচীন পুঁথি। বেশ কয়েক জন পণ্ডিত এই গ্রামে বিদ্যাচর্চা করতেন। তাদের কারুর কারুর মতে, সবথেকে আগে যোগাদ্যা বন্দনা লিখেছিলেন কবি কৃত্তিবাস। কবির মতে, রামায়ণের কালে মহীরাবণ বধের পরে তারই পূজিতা ভদ্রকালী বা যোগাদ্যাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেন রামচন্দ্র।

কবির লিখিত কাহিনিটি ছিল এ রকম, মহীরাবণ রাম-লক্ষ্মণকে বেঁধে পাতালে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে দেবীর সামনে তাদের বলি দেবে বলে ঠিক করেছে মহীরাবণ। কিন্তু হনুমান মাছির রূপ ধরে দেবীকে রাম-লক্ষ্মণের পরিচয় জানিয়ে দেন। দেবী তখন হনুমানকে বুদ্ধি দেন, রামকে বলি দেওয়ার আগে মহীরাবণ যখন দেবীকে প্রণাম করতে বলবে, রাম যেন তখন তাকে বলেন, তিনি রাজা তাই তিনি প্রণাম করতে জানেন না।

মহীরাবণ হেঁট হয়ে দেবীকে প্রণাম করতে গেলেই খাঁড়া দিয়ে তার মাথা কেটে ফেলতে হবে। রামচন্দ্র সেই ভাবেই মহীরাবণ বধ করেছিলেন । এর পরে রাম দেবীকে নিয়ে পাতাল থেকে উঠে আসেন এই ক্ষীরগ্ৰামে। দেবী যোগাদ্যাকে এই ক্ষীরগ্ৰামে প্রতিষ্ঠা করে রামচন্দ্র লক্ষণকে নিয়ে চলে যান।

Jogaddya-Fair2

কিন্তু দেবীমূর্তিটি একসময়ে হারিয়ে গিয়েছিল। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচন্দ্র এই ক্ষীরকন্ঠ গ্ৰামে দেবী যোগাদ্যার একটি মন্দির তৈরি করান এবং তাঁর আদেশে হারিয়ে যাওয়া দেবীমূর্তির মতই কষ্টিপাথরের একটি দশভুজা মহিষমর্দিনী দেবীমূর্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন দাইহাটার প্রসিদ্ধ নবীন ভাস্কর (ইনিই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের দেবী ভবতারিণীর মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন)।

মা যোগাদ্যার এই মূর্তি কিন্তু বছরের তিনশো ঊনষাট দিন মন্দিরের গায়ে লাগানো জলাশয় ক্ষীরদিঘীর জলের তলায় থাকে। মাত্র ছ'দিন আগে তাঁকে জল থেকে তোলা হয়। সেই ছ'দিনের মধ্যে মাত্র দু'দিন ভক্তরা দেবীর দর্শন করতে পারেন। এই দুটি দিন হল বৈশাখ মাসের সংক্রান্তি এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের চার তারিখ।

বৈশাখী সংক্রান্তির আগের দিন দেবীকে জল থেকে তুলে নিয়ে আসা হয় মন্দিরে। মহা ধূমধাম করে দেবীর পুজো হয়। সেই উপলক্ষ্যে মেলা বসে মন্দির সংলগ্ন এলাকা জুড়ে। মায়ের পুজোয় বলিদানের প্রথা রয়েছে। বহু পূর্বে এখানে নরবলি হত। কিন্তু এখন সেই কুপ্রথা বন্ধ হলেও ছাগবলি ও মোষ বলি হয়ে থাকে।

বর্ধমানের অন্যান্য গ্ৰাম বা শহর থেকে তো বটেই, পাশাপাশি অন্যান্য জেলা থেকেও প্রচুর মানুষ আসেন দেবীদর্শনের আকাঙ্ক্ষায় এবং মেলা দেখতে। জাত, ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ আসেন মায়ের পুজো দিতে। এই গ্ৰামের যে কোনো শুভ কাজ দেবী যোগাদ্যার পুজো করেই শুরু হয়। কিছু বছর আগে পুরনো মূর্তিটিও পাওয়া যায়।

গ্ৰামবাসীরা নিজেরা একটি মন্দির নির্মাণ করে সেখানে পুরনো মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বৈশাখী সংক্রান্তিতে দুটি মন্দিরেই দেবীর পূজা হয়। ভক্তরা আসেন, দেবী যোগাদ্যার পুজো দিয়ে মেলায় বেড়ান। নানান পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানদারেরা। প্রচুর বিকিকিনি চলে। পনের দিন ধরে চলে এই মেলা।

বন্ধুরা, ভাল লাগল এই সতীপীঠ ক্ষীরগ্ৰামের মেলা? আবার আসব আপনাদের কাছে। নতুন মেলায় যেতে হবে না?

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...