গত সপ্তাহে আমরা মেলা দেখতে গেলাম আমতা। মানে হাওড়া জেলা। তা হাওড়া জেলাতেই থাকি এই সপ্তাহেও। এই জেলায় চমৎকার কিছু মেলা বসে। চলুন, তারই একটা আজ দেখতে যাই। এই মেলা বসে হাওড়া জেলার পশ্চিম প্রান্তে আছে সোনাতলা গ্ৰাম...তার ও পশ্চিম সীমান্তে মানশ্রী গ্ৰাম।
সেখানে আছে দেবী ঈশানকুমারীর থান। আর এখানেই বসে ঈশানকুমারীর মেলা। আজ এই মেলাতেই নিয়ে যাবো আমার পাঠক বন্ধুদের। তাহলে চলুন রওনা দিই। সময়ের পথ ধরে পিছন দিকে যাবো কিন্তু। অর্থাৎ এটা তো জ্যৈষ্ঠ মাস। আমরা যাবো দু মাস পিছনে মানে চৈত্র মাসে। চৈত্রের সাত আর আট তারিখ বসে দেবী ঈশানকুমারীর মেলা।
এই যে দেবী ঈশানকুমারী... ইনি কিন্তু খুব বেশি পরিচিতা নন। তিনি একজন গ্ৰাম্য দেবী। হাওড়া এবং হুগলি এই দুই জেলারই সীমানার উপর এই মানশ্রী গ্ৰাম। নামটি কেমন সুন্দর তাই না? কিন্তু এই মেলায় যাওয়ার আগে এই এলাকার ভৌগলিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাপনের ছবিটা একটু দেখে নেওয়া যাক।
কারণ একটা জেলার বা অঞ্চলের মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রার পরিচয় সেখানকার মেলাগুলির মধ্যে ফুটে ওঠে। হাওড়া জেলা নদীমাতৃক জেলা। আর যদিও হাওড়া জেলায় বেশ কয়েকটা শহর রয়েছে তবুও এই জেলার সভ্যতা সংস্কৃতি মোটামুটি গ্ৰাম কেন্দ্রিক এবং মানুষজন মোটের উপর কৃষিনির্ভর।
বেশ কয়েকটি বড়ো বড়ো নদী এই জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে বন্যা হয়েই থাকে। তাই বলা যেতেই পারে যে এই জেলায় যে মেলাগুলো বসে বা আয়োজিত হয় বেশিরভাগ সময় সেগুলোর কেন্দ্রে থাকে কোনো না কোনো দেবদেবীর আরাধনা। বন্যা থেকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে, মহামারীর হাত থেকে বা খরার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষ দেবদেবীর পূজা আরাধনার আশ্রয় নেয়।
এই গ্ৰাম্য দেবী ইশানকুমারীও তেমন একজন দেবী। হাওড়া জেলার পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে গেছে মুণ্ডেশ্বরী নদী। আর অতিবৃষ্টি হলেই এই এলাকা জলপ্লাবিত হয়। মুণ্ডেশ্বরী নদী ভাসিয়ে নিয়ে যায় এই সোনাতলা গ্ৰাম, মানশ্রী গ্ৰাম। বন্যায়, সাপের কামড়ে, অসুখে বর্ষার সময় প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হন এবং মারা যান।
স্থানীয় মানুষের ধারণা দেবী ঈশান কুমারীর কোপে এমন দুর্যোগ ঘটে থাকে। সেই কারণে, সাপের কামড় থেকে বাঁচতে তাঁরা দেবীকে তুষ্ট করার জন্য মহা সমারোহে পুজো করে দেবীর। ঈশান কুমারীর পূজা হয় চৈত্র মাসের সাত ও আট তারিখে। বিশেষ যাগযজ্ঞ হয় এই পুজো উপলক্ষে। একটি প্রাচীন গাছের তলায় দেবীর মন্দির। প্রচুর মানুষ পুজো দিয়ে খিচুড়ি ভোগ খান গাছের ছায়ায় বসে। বেশ বড়সড় একটা মেলা বসে।
মেলায় যেমন পুতুল, খেলনা, খাবার জিনিস, গৃহস্থালীর সামগ্ৰী বিক্রি হয় তেমনি কৃষি কাজের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও এই মেলায় বিক্রিবাটা হয়। সারারাত ধরে মনসামঙ্গল গাওয়া হয়, দেবীর নাম গান করা হয়। ঈশান কুমারী সাপের দেবী মনসারই একটি রূপ। তবে এই মানশ্রী গ্ৰামে দেবীর আবির্ভাব কবে কেউই ঠিকমতো জানেন না। কিন্তু না জেনেও মানুষ দেবী ঈশানকুমারীকে ভক্তি ভরে পূজা দেন। মেলায় আনন্দ করে বেড়িয়ে কেনাকাটা করে খুশিমনে বাড়ি ফেরেন।
পাঠকবন্ধুরা, মেলায় মেলায় মানস ভ্রমণ করতে ভালো লাগছে তো? সত্যিকারের যদি বেরোতে হয় মাস্ক পরতে আর স্যানিটাইজার নিতে কিছুতেই ভুলবেন না কিন্তু। পরের সপ্তাহে আবার নতুন কোনো মেলা...