পাঠক বন্ধুরা, কতোগুলো মেলায় বেড়াতে গেলাম আমরা? কি জানি! মনেও নেই। আমার সুন্দরী, সুজলা সুফলা বঙ্গে উৎসবেরও অভাব নেই, পালা পার্বণ তো সারা বছর জুড়ে চলতে থাকে। আর বেশিরভাগ মেলাই তো কোনো ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে বসে... তা সে যে ধর্মেরই হোক না কেন..। আর আমার বাংলায় মেলাগুলি আশ্চর্য রকমের ধর্ম নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলে। এ আমাদের অহংকার সত্যিই। হ্যাঁ যা বলছিলাম, বঙ্গভূমে মেলার অভাব নেই। আমাদের বেড়ানোর ও বিরাম নেই। মেলায় বেড়ানোর মতো আনন্দ আর কোথাও নেই যে...
আর কথা বাড়িয়ে কাজ নেই... সোজা কাজে লেগে পড়ি অর্থাৎ কিনা নতুন মেলার পথে রওনা দিই। আজ আমরা যে মেলায় যাবো সেই মেলা এক দেবীর পুজোকে কেন্দ্র করেই বসে। মজার বিষয় হল সেই দেবীর নাম শুরুই হয় মেলা দিয়ে। তাহলে... গুপি বাঘার জুতোয় পা গলিয়ে হাতে হাতে তালি দিই আর.... চললাম আমরা হাওড়া আমতা "মেলাই চণ্ডীর মেলা"। বলেছিলাম না দেবীর নাম শুরুই হয় "মেলা" দিয়ে!
হাওড়া জেলার আমতা একটি বর্ধিষ্ণু জনপদ। আর এই আমতাতেই আছে দেবী মেলাই চণ্ডীর মন্দির। আমতা এলাকার সর্বজনশ্রদ্ধেয় লৌকিক দেবী হলেন মা মেলাই চণ্ডী। প্রায় সাড়ে চারশো বছরের পুরনো এই মূর্তি। হয়তো আমার মতো বেশিরভাগ মানুষেরই অজানা যে মেলাই চণ্ডীর মন্দির একটি সতীপীঠ।
অবশ্য এ নিয়ে একটা তথ্য জানানো যাক। আসল বা পুরনো মেলাইচণ্ডী মন্দির আগে ছিল হাওড়ারই জয়ন্তী গ্ৰামে। পুরাণের উপাখ্যান অনুযায়ী এখানে দেবী সতীর পায়ের মালাইচাকি পড়েছিল। সেই কারণেই দেবী চণ্ডীর আগমন ঘটে এবং লোকমুখে দেবীর নাম হয়ে যায় মালাই চণ্ডী যা সময়ের সাথে সাথে মেলাই চণ্ডীতে রূপান্তরিত হয়। এখানে দেবীর পূর্ণাঙ্গ রূপ নেই। মালাইচাকির ওপর ভিত্তি করে তৈরি। দেবীর বাহু ও পদযুগল নেই।
জয়ন্তী গ্ৰাম থেকে আমতায় দেবীকে নিয়ে আসেন এবং প্রতিষ্ঠা করেন জটাধারী চক্রবর্তী নামে এক ব্রাহ্মণ। ইংরেজি ১৬৪৯ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতা হাটখোলার বিখ্যাত লবণ ব্যবসায়ী কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত দেবীর আটচালা মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন। এই মন্দির হাওড়া জেলার প্রাচীনতম মন্দির। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেও আমতার মেলাইচণ্ডীর উল্লেখ রয়েছে। তার থেকেই এই মন্দিরের প্রাচীনত্ব বোঝা যায়।
সারাবছর এই মন্দিরে দেবীর নিত্য পূজা হয়। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন প্রতিষ্ঠা দিবস। তাই বৈশাখী পূর্ণিমাতে দেবীর বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়। এই পুজো উপলক্ষ্যে আমতায় বিশাল মেলা বসে। আমতাবাসী ছাড়াও বিভিন্ন গ্ৰাম থেকে বহু মানুষ সেই সময় দেবীকে গরুর দুধ দিয়ে পুজো দিতে আসেন। স্থানীয় মানুষ দেবী মেলাই চণ্ডীকে বলে "জগৎমাতা"।
প্রচলিত আছে যে অত্যন্ত জাগ্ৰত এই দেবীর কাছে প্রার্থনা করে কেউ খালি হাতে ফিরে যায় না। মেলায় নানান জিনিসের দোকান বসে। বুড়ো থেকে ছোট... সব মানুষের ভিড় জমে এই মেলায়। বৈশাখী পূর্ণিমার এই মেলা কিন্তু শুধু দেবী মেলাইচণ্ডীর ভক্তদেরই বাঁধেনি, সম্প্রীতির ডোরে বেঁধে রাখে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষকে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ আসেন মায়ের কাছে এবং মেলা দেখতে। এখানেই সার্থক হয়ে ওঠে শতাব্দী প্রাচীন এই মেলা।
পাঠক বন্ধুরা, আমরা যখন যে মেলাতেই ঘুরতে যাই না কেন কেউ কিন্তু মাস্ক পরতে ভুলবেন না। এই অতিমারীকে আমরা নিশ্চিতভাবেই হারিয়ে দিতে পারব। এখন তো মানস ভ্রমণ করছি, একবার পৃথিবী স্বাভাবিক হয়ে উঠুক তখন আর আমাদের পায় কে... ততদিন সবাই একটু সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন