বাংলার মেলা: মাহেশের রথের মেলা

রথের মেলা দর্শন...এবার চতুর্থ পর্ব। এই পর্বে পাঠকবন্ধুদের নিয়ে যাওয়া হবে .... আবারও হুগলি জেলায়। এবারের রথদর্শন...৬২৫ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যময় মাহেশের রথযাত্রা। তাহলে রওনা দেওয়া যাক? শুরু হোক "মিশন মাহেশ" ।

প্রথমেই এই অতি বিখ্যাত রথের ইতিহাস। তারপর মেলা ও রথ দেখা। না না কলা বেচতে হবে না। কিন্তু মেলায় ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র দেখা, টুকিটাকি কেনাকাটা, পাঁপড় ভাজা, ঘুগনি আর জিলিপি খাওয়া – এগুলো কি কম গুরুত্বপূর্ণ!

প্রাচীনত্ব এবং ঐতিহ্যের নিরিখে পুরীর পরেই নাম আসে মাহেশের রথযাত্রার। মাহেশকে বলা হয় 'নব নীলাচল'। অর্থাৎ নতুন পুরী। প্রচলিত রয়েছে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু একবার পুরী যাত্রার পথে মাহেশের মন্দির দেখতে এসেছিলেন। এখানে তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েন এবং সমাধিস্থ হন। তখন থেকে এই জায়গার নাম রাখা হয় "নব নীলাচল"।

MaheshRath4

পুরীর মতোই এখানে ভগবান পুরুষোত্তমের আশীর্বাদ পেতে বহু দূর দূরান্ত থেকে হাজির হন লক্ষাধিক ভক্তজন। মাহেশের রথের সাথে জড়িয়ে রয়েছে বহু প্রাচীন ইতিহাস। এই উৎসব ১৩৯৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই রথযাত্রা পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং বাংলার প্রাচীনতম ও বৃহত্তম রথযাত্রা। রথযাত্রার সময় মাহেশের এক মাস ধরে মেলা চলে।

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'রাধারানী' উপন্যাসেও মাহেশের এই শতাব্দী প্রাচীন রথের মেলার উল্লেখ এবং বর্ণনা রয়েছে। মাহেশের রথের মেলার প্রেক্ষাপটেই এই উপন্যাস রচনা করেছিলেন তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, মা সারদা দেবী, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিখ্যাত মানুষেরা মাহেশের এই বিখ্যাত মেলায় পদার্পণ করেছিলেন।

প্রচলিত কাহিনী – চতুর্দশ শতাব্দীতে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক ব্যক্তি পুরীতে তীর্থ করতে যান। তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল জগন্নাথদেবকে দর্শন করে তাঁকে ভোগ খাওয়াবেন তিনি। কিন্তু মন্দির কর্তৃপক্ষ তাতে বাধা দেন। মনের দুঃখে ধ্রুবানন্দ অনশন করে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেবেন বলে ঠিক করেন। কিন্তু অনশনের তৃতীয় রাতে তিনি ভগবান শ্রী জগন্নাথ দেবের স্বপ্নাদেশ পান তিনি। স্বয়ং ভগবান তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বলেন হুগলির মাহেশে যেতে।

MaheshRath1

তাঁর ইচ্ছানুসারে ধ্রুবানন্দ মাহেশে এসে উপস্থিত হন। স্বপ্নে তাকে ভগবান দারুব্রহ্ম এমনও জানিয়েছিলেন যে ঠিক সময়ে তিনি দেবমূর্তি তৈরির কাঠ পেয়ে যাবেন এবং সেই কাঠ গঙ্গাতেই ভেসে আসবে। প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝার এক রাতে গঙ্গার ধারে বসেছিলেন ধ্রুবানন্দ। সেইসময় গঙ্গায় একটি নিমকাঠ ভেসে আসে।

সেই নিমকাঠ সংগ্ৰহ করলেন ধ্রুবানন্দ এবং ঐ নিমকাঠ দিয়েই জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার বিগ্রহ নির্মাণ করে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। কালের প্রভাবে সেই মন্দিরটি নষ্ট হয়ে গঙ্গা গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। জি টি রোডের ধারে বর্তমান মন্দিরটি ১৭৫৫ সালে তৈরি করে দিয়েছিলেন কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার নারায়ণ চন্দ্র মল্লিক নামে এক ভক্ত।

মাহেশের রথযাত্রার ইতিহাসে প্রথম রথটি তৈরি করে দিয়েছিলেন একজন মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী। ১৭৯৭ সালে মন্দিরে কাঠের রথ বানিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের শিষ্য বলরাম বসুর দাদু কৃষ্ণরাম বসু। তিনি পাঁচটি চূড়াবিশিষ্ট একটি অতি সুন্দর কাঠের রথ তৈরি করে দেন। প্রতিশ্রুতি দেন তিনিই এই রথযাত্রার যাবতীয় খরচ বহন করবেন। রথ চলাচলের জন্য মাহেশ থেকে বল্লভপুর পর্যন্ত দেড় মাইল রাস্তাও তৈরি করে দিয়েছিলেন এই মহাপ্রাণ মানুষটি।

MaheshRath2

তখন থেকে এই বসু পরিবারই মাহেশের রথযাত্রার দায়িত্ব নিয়ে আসছে। সেই রথটিও একসময় জীর্ণ হয়ে পড়ে। তখন ১৭৯৮ সালে কৃষ্ণরাম বসুর পুত্র গুরুপ্রসাদ বসু ন’টি চূড়াবিশিষ্ট নতুন কাঠের রথ নির্মাণ করিয়ে দেন। ১৮৮৪ সালে রথযাত্রার দিন বল্লভপুরে গুন্ডিচাবাটীতে সেই রথটি পুড়ে যায়। বসু পরিবারেরই বংশধর শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র বসু পরের বছর বর্তমান লোহার রথটি তৈরি করিয়ে দেন। তখন থেকে এই রথটিই শ্রীজগন্নাথ দেবকে নিয়ে যাত্রা করে।

মার্টিন বার্ন কোম্পানি এই রথটি তৈরি করেছিল। সেই সময় এর দাম পড়েছিল ২০ হাজার টাকা। এই রথটি লোহার কাঠামোর উপর কাঠ দিয়ে তৈরি। চারটি তলবিশিষ্ট এই রথের উচ্চতা ৫০ ফুট। ওজন ১২৫ টন। ১২টি লোহার চাকা রয়েছে এর। রথের গায়ে একতলায় চৈতন্যলীলা, দ্বিতীয় তলায় কৃষ্ণলীলা এবং তৃতীয় তলে রামলীলা চিত্রিত করা আছে। চার তলায় শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের বিগ্রহ বসানো হয়। রথের সামনে দুটি তামার ঘোড়া লাগানো হয়। কাঠ নির্মিত সারথিও থাকে তাদের। ১৮৮৫ সাল থেকে এই রথের যাত্রা শুরু হয়।

স্নানযাত্রার পরদিন মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ প্রচুর জলে ভিজে দেবদেবীদের "জ্বর" আসে। তাঁদের "চিকিৎসা" করেন তিনজন কবিরাজ। জগন্নাথ দেব, বলরাম এবং সুভদ্রার জন্য "পাঁচন" প্রস্তুত করেন তাঁরা। এই পাঁচন সেবন করে তিন দেবদেবী সুস্থ হয়ে ওঠেন। রথের আগের দিন মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া হয়। সেদিনই শ্রীজগন্নাথ দেবকে রাজা রূপে অভিষিক্ত করা হয়। তিন দেবদেবীর অঙ্গে ওঠে নতুন পোশাক। বিশেষ সজ্জায় সজ্জিত করা হয় তাঁদের। এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় "নব কলেবর"।

রথযাত্রার দিন রথে চাপিয়ে বিশাল ধূমধাম সহকারে দেবতাদের নিয়ে যাওয়া হয় গুণ্ডিচাবাটীতে। মাহেশে গুণ্ডিচাবাটীকে বলা হয় "কুঞ্জবাটি" বা মাসির বাড়ি। তবে এই মাসি কিন্তু জগন্নাথ দেবের মায়ের বোন নন; তিনি হলেন পুরুষোত্তম ভগবানের বান্ধবী "পৌর্ণমাসী"।

অসংখ্য ভক্ত রশি টেনে পায়ে হেঁটে জিটি রোড ধরে সাড়ম্বরে দেবদেবীদের মাসীর কুঞ্জবাটিতে পৌঁছে দেন। যাত্রাপথে কাঁসর ঘন্টা তো বাজেই, তার সঙ্গে বাজে বিউগল। সাধারণ দিনগুলিতে ভক্তদের দেবদেবীর বিগ্রহ স্পর্শ করতে দেওয়া হয় না। কিন্তু, সোজা রথ এবং উল্টো রথের দিন ভক্তরা বিগ্রহ স্পর্শ করতে প্রণাম করতে পারেন। এমনকি দেবদেবীদের মালা পরিয়ে প্রার্থনাও জানাতে পারেন।

MaheshRath3

লক্ষীদেবীকে মন্দিরে একা রেখেই শ্রী জগন্নাথদেব বান্ধবীর বাড়িতে বেড়াতে চলে যান। মাহেশের রথযাত্রার আরেকটি উল্লেখযোগ্য অংশ হল একদিনের "হোড়াপঞ্চমী" উৎসব। রথযাত্রা শুরুর পঞ্চম দিনে এই উৎসব হয়। সেদিন পালকিতে চড়িয়ে মশাল নিয়ে এলাকার ছেলেরা মন্দির থেকে মালক্ষ্মীকে কুঞ্জবাটিতে বা মাসীর বাড়িতে নিয়ে যায়।

সেখানে লক্ষ্মীদেবী সর্ষে পোড়া দিয়ে জগন্নাথদেবকে বশ করেন বা বশ করার চেষ্টা করেন যাতে ভগবান পুরুষোত্তম বান্ধবীকে ছেড়ে আবার তাঁর কাছে ফিরে আসেন। কী মজার উৎসব তাই না? এই সর্ষে পোড়া নিতে বহু ভক্ত ভীড় জমান।
ন'দিনের মাথায় উল্টোরথে ভগবান জগন্নাথদেব আবার ফিরে আসেন তাঁর নিজের মন্দিরে।

জিটি রোডের দু পাশে বসে বিশাল মেলা। সারা জেলা এবং রাজ্য থেকে দলে দলে মানুষ আসেন এই রথযাত্রা উৎসব দেখতে। মেলায় প্রচুর কেনাকাটা চলে। নাগরদোলা, চরকি সহ ছোট ও বড়দের জন্য নানারকম 'জয়রাইড' থাকে। আর রথের মেলায় বিশেষ খাবারের আয়োজন তো থাকবেই।

জিলিপি আর পাঁপড়ভাজা এবং শ্রীজগন্নাথদেবের অতি প্রিয় মালপোয়া তো "মাস্ট"... সোজা রথ বা উল্টোরথের দিন ভগবান দারুব্রহ্মের ভোগে মালপোয়া থাকবেই। আর জগন্নাথ দেবের ভোগে কিন্তু এমনি সাধারণ সাদা নুন দেওয়া হয় না; তাঁর ভোগ রান্না করা হয় সৈন্ধব লবণ সহযোগে। এছাড়াও এই মাহেশের বিখ্যাত "গুটখে সন্দেশ"ও নাকি জগন্নাথ দেবের ভারী পছন্দের মিষ্টি। তাই এখনও পর্যন্ত ভক্তরা এই মাহেশে রথযাত্রা উপলক্ষে এলে গুটখে সন্দেশ কিনে তা ভগবানকে নিবেদন করেন।

মাহেশের রথ নিয়ে মন্দিরের দেবতার পূজারীদের মুখে মুখে প্রচলিত একটি ছড়া দিয়ে এই রথযাত্রা পর্ব শেষ করা যাক?

"নীলাচলে পুরুষোত্তম জগন্নাথ নাম।
সেই নাম প্রকট হয় মাহেশের ধাম।।"

নিত্য পূজা, নিত্য ভোগ, নিত্য শাস্ত্র পাঠ।
ভক্তজনে জানে তাই মাহেশ শ্রীপাট।।’’

পাঠক বন্ধুরা, ভালো লাগল এই "মানস মাহেশমেলা" ভ্রমণ?

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...