বাংলার মেলা: হুগলি দেবানন্দপুরের মাছ মেলা

কথাতেই বলে 'মাছে ভাতে বাঙালি'... বাঙালি জাতির সবথেকে প্রিয় খাবার কী... এই প্রশ্ন উঠলেই সবাই সমস্বরে একটা উত্তরই দেবে...মাছের ঝোল ভাত। আর এই মাছ নিয়েই যদি হয় আস্ত একটা মেলা যেখানে মানুষ ইচ্ছে মত সাধ মিটিয়ে মাছ কিনতে পারবে - তাহলে কেমন হয় বলুন তো? ভাবলেই মনটা বেশ খুশিয়াল হয়ে উঠছে না? চলুন, আজ আপনাদের নিয়ে সত্যিকারের এমন একটি মেলায় নিয়ে যাই।

হুগলি জেলায় সরস্বতী নদীর পাড় ঘেঁষা দেবানন্দপুরের কৃষ্ণপুরে এই মাছ মেলা বসে প্রত্যেক বছর পয়লা মাঘ। এবার এই মেলার ইতিহাস নিয়ে একটু কথা বলি?

এই মেলা পাঁচশো বছরেরও বেশি পুরনো। কথিত আছে - হুগলি জেলার আদি সপ্তগ্ৰামের কৃষ্ণপুরের জমিদার গোবর্ধন গোস্বামীর ছেলে ছিলেন বৈষ্ণব চূড়ামনি রঘুনাথ দাস গোস্বামী।

শ্রীশ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ শিষ্য রঘুনাথ দাস বাবার বিপুল সম্পত্তি ত্যাগ করে শ্রীচৈতন্যদেবের অনুগামী হয়ে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেন। ন'মাস পরে এক শীতের দিনে তিনি নিজের বাড়িতে ফিরলেন।

ছেলে ঘরে ফিরেছে... আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন পিতা গোবর্ধন গোস্বামী। ঠিক করলেন এই উপলক্ষে গ্ৰামের সব মানুষকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াবেন। তখন ছিল শীতকাল। গ্ৰামবাসীরা রঘুনাথ দাস কত বড় ভক্ত হয়েছেন তার পরীক্ষা নেওয়ার জন্য শীতকালেই কাঁচা আম দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন।

সমস্যায় পড়ে গেলেন জমিদার মশাই কারণ শীতকালে কাঁচা আম বা ভাল ইলিশ মাছ দুটোই দুষ্প্রাপ্য। বাবাকে চিন্তিত দেখে রঘুনাথ একটু হেসে গ্ৰামবাসীদের বললেন বাড়ির জোড়া আমগাছ থেকে আম পেড়ে আনতে এবং বাড়িরই পুকুর থেকে ইলিশ মাছ ধরতে।

আশ্চর্যের বিষয় যে দুটি জিনিসই পাওয়া যায় রঘুনাথ দাসের কথা মত। শীতকালেও গাছে পাওয়া গেল কাঁচা আম এবং পুকুরে জাল ফেলে উঠল অগুন্তি ইলিশ। এই অলৌকিক ব্যাপার দেখে প্রজারা জয়ধ্বনি দিয়ে উঠলেন রঘুনাথ দাস গোস্বামী এবং গোবর্ধন গোস্বামীর নামে। সেই তারিখটি ছিল মাঘ মাসের প্রথম দিন।

বিরাট ভোজের আসর বসে জমিদার গোবর্ধন গোস্বামীর বাড়িতে। এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে পরের বছর থেকেই গোস্বামী ভিটেতে চালু হয় এই মাছের মেলা। সেই থেকে প্রতি বছর পয়লা মাঘ রাধাগোবিন্দ মন্দিরে পুজো দিয়ে শুরু করা হয় এই মেলা।

কী মাছ পাওয়া যায় না এই মাছ মেলাতে! রুই, কাতলা, ভেটকি, ইলিশ, চিংড়ি... মাছবিলাসী মানুষদের স্বর্গ একেবারে। পঞ্চাশ জনের মত মাছ ব্যবসায়ী আসেন তাদের বিভিন্ন ধরনের মাছের পশরা নিয়ে। পুকুর বা নদীর মাছ ছাড়াও থাকে বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ।

হুগলি তো বটেই, তার বাইরে বর্ধমান বা দুই চব্বিশ পরগনা থেকেও ক্রেতা ও বিক্রেতাদের ভিড় জমে এই পাঁচশো বছরেরও বেশি পুরনো ঐতিহ্যের মেলায়। বিভিন্ন ধরনের, মাপের, দামের এবং ওজনের মাছ বিক্রি হয় এই একদিনের জন্য বসা মেলাতে।

মাছ ছাড়াও বিভিন্ন মনোহারী জিনিস সাজিয়ে নিয়ে বসেন দোকানদারেরা। সারাদিন ধরে ঘুরে, দরদাম করে মাছ এবং গৃহস্থালীর নানান জিনিস কিনে তৃপ্ত মনে ক্রেতারা ফেরেন তাদের ঘরে এবং বিক্রেতারাও হাসি মুখে বাড়ির পথ ধরেন।

মাছ মেলায় বেড়াতে কেমন লাগল পাঠকবন্ধুরা? পরের সপ্তাহে আবার নতুন মেলায় ডানা মেলার অপেক্ষা...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...