বাংলার মেলা: গুপ্তিপাড়ার শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার মেলা

বসেছে আজ রথের তলায়
স্নানযাত্রার মেলা--
সকাল থেকে বাদল হল,
ফুরিয়ে এল বেলা।

আজকে দিনের মেলামেশা
যত খুশি যতই নেশা

সবার চেয়ে আনন্দময়
ওই মেয়েটির হাসি--
এক পয়সায় কিনিছে
তালপাতার এক বাঁশি।
(সুখ দুঃখ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

পড়ে গেল আষাঢ় মাস। হৈ হৈ করে এসে পড়ল বর্ষা কাল। দিনে রাতে যখন তখন ঝমঝমিয়ে নামছে বৃষ্টি। আর এই "ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে" আমাদের "কিছুতে কেন যে মন লাগে না" সেটা আমরা সবসময় সত্যিই বুঝে উঠতে পারি না। "মন মোর মেঘের সঙ্গী" হয়ে "উড়ে চলে দিকদিগন্তের পানে"... ‌সত্যিই আমাদের শরীর হয়তো ঘরের মধ্যে থাকে কিন্তু মনকে কি আটকে রাখা যায়? সে যে সব বাধা পেরিয়ে ছুটে চলে কত না দূরদূরান্তে...জানা অজানা দেশে।

মেলা নিয়ে লিখতে বসে এতগুলো কথা লিখলাম কেন জানেন? কারণ আমাদের এই যে মেলায় মেলায় ঘুরে বেড়ানো- এ ও তো আসলে নিজের মনের আগল খুলে দিয়ে তাকে তার নিজের মতো ডানা মেলে উড়তে দেওয়া তাই না?

আচ্ছা বন্ধুরা, বর্ষাকাল আসলেই, বিশেষ করে আষাঢ় মাস শুরু হলেই আমাদের কোন উৎসব বা মেলার কথা মনে পড়ে বলুন তো? আমি জানি আপনারা সবাই মিলে একসঙ্গে বলবেন "রথযাত্রা" বা "রথের মেলা"...। একদম ঠিক; আজ থেকে কয়েক দিন পরেই জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। আর এই পুরো আষাঢ় মাস জুড়েই চলবে শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবকে নিয়ে নানান উৎসব এবং সেই উপলক্ষে সারা রাজ্যজুড়ে বসবে কত সুন্দর সুন্দর মেলা। তাই পাঠকবন্ধুরা, এই পুরো আষাঢ় মাস ধরে আমরা ঘুরে বেড়াব বেশ কয়েকটা রথের মেলায়। হতে পারে সেই মেলাগুলোর কোনো কোনোটা অতি বিখ্যাত; আবার কোনো কোনো রথের মেলা ছোট কিন্তু বহুদিনের ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছে।

guptipara1

হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীজগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা পালিত হয়। জগন্নাথের ভক্তদের কাছে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই দিনটিকে জগন্নাথের জন্মতিথি বলে মনে করা হয়। এইবছর আগামী ইংরেজি চব্বিশে জুন শুক্রবার এই বছরের স্নানযাত্রা তিথি। আজ শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের এই স্নানযাত্রা এবং সেই উপলক্ষে মেলা দেখতে আমরা যাব হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায়।

গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রার ইতিহাস প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো। অনেকে গুপ্তিপাড়াকে গুপ্তবৃন্দাবন মনে করেন। এখানে রয়েছে শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির। আর এই মন্দিরেই বাস করেন স্বয়ং ভগবান দারুব্রহ্ম। এবং এই বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত শ্রীজগন্নাথদেবের ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা গুপ্তিপাড়ার অন্যতম প্রধান অহঙ্কারেরও। এত উঁচু রথ সম্ভবতঃ বাংলার আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। ন’টি চূড়াযুক্ত এই রথে নানা রঙের পতাকা লাগানো থাকে। থাকে নানান রকমের রঙিন কাঠের পুতুল।

রথযাত্রার মোটামুটি দিন পনেরো আগে শ্রী শ্রী জগন্নাথদেব, বলভদ্র এবং তাঁদের বোন দেবী সুভদ্রা'র স্নানকে কেন্দ্র করে হয় স্নানযাত্রা উৎসব(যে বছর যেদিন স্নানযাত্রার তিথি পড়ে সেই অনুযায়ী).. বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির থেকে তিন দেবদেবীর কাঠেরমূর্তি নিয়ে যাওয়া হয় মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বেশ উঁচু একটি মঞ্চের উপরে। দুঘণ্টা সময় ধরে চলে পুজোপাঠ। এর পর শুরু হয় জগন্নাথদেবের স্নানপর্ব।

বিশালাকৃতি গামলা বা পাত্রে দুধের সঙ্গে মেশানো হয় গঙ্গাজল, ফুল-সহ আরো নানা সুগন্ধি উপকরণ। সেই সুগন্ধময় জল বা জল মিশ্রিত দুধে জাঁকজমক সহকারে স্নান করানো হয় এই তিন দেবদেবীকে। গুপ্তিপাড়া এবং আশেপাশের নানা গ্ৰাম থেকে প্রচুর মানুষ এসে থাকেন জগন্নাথের এই স্নানযাত্রায়। এই স্নানের জল দেবতার প্রসাদ হিসেবে ভক্তরা মঞ্চের নিচে দাঁড়িয়ে পান করেন। কেউ কেউ শিশি বা বোতলে ভরে বাড়িতেও নিয়ে যান। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, এই পুণ্য উদক পান করলে দেহের সমস্ত রোগজীবানু বিনষ্ট হয়। মন্দিরের পশ্চিমে রাখা রথেরও এদিন পুজো হয়।

ভগবান জগন্নাথদেবের এই মহাস্নানযাত্রা উপলক্ষ্যে গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরের পাশে বসে একটি মেলা। তাতে বসে এলাকার মাটির খেলনা, ছোটখাটো ঘরকন্নার সামগ্রী, মুখরোচক বিভিন্ন খাবার-সহ নানা দোকান। এই অনুষ্ঠানের জন্য সকাল থেকে অসংখ্য ভক্ত সমাগম হয়। এই অঞ্চলের প্রচুর মানুষজনের ভিড় জমে। ভক্তরা অতি আনন্দে মহা সমারোহে অনুষ্ঠিত এই স্নানযাত্রা প্রত্যক্ষ করেন। তারপর মেলায় ঘোরেন। মেলায় ছোটরা এবং মেয়েরা মনের সুখে টুকিটাকি জিনিসপত্র কেনে, খাবার জিনিস কেনে; তারপর বাড়ির পথ ধরে। এই যে এতদিন ধরে চলে আসা একটি উৎসব দেখার জন্য মানুষের এত আগ্ৰহ, উৎসাহ, উদ্দীপনা-- এই দেখে সত্যিই মনে হয় সেই শ্রেষ্ঠ বঙ্গসন্তানটির লেখা কবিতার লাইনগুলো কতোটা সত্যি:

" হে মোর চিত্ত,পুণ্য তীর্থে
জাগো রে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।

হেথায় দাঁড়ায়ে দু-বাহু বাড়ায়ে
নমি নর-দেবতারে,
উদার ছন্দে পরমানন্দে
বন্দন করি তাঁরে।..............................
.......
কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে
কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে
সমুদ্রে হল হারা।"
–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমার পাঠকবন্ধুরা, সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। এই পুরো মাস ধরে কিন্তু অনেকগুলো রথের মেলা দেখতে হবে আমার সঙ্গে বর্ষার ঝুমঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে..

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...