বাংলার মেলা: গোবরডাঙার মশলা মেলা

আজ তো বৈশাখ মাসের চার তারিখ। প্রথমেই আমার সমস্ত পাঠক বন্ধুকে জানাই নববর্ষের আন্তরিক শুভেচ্ছা। সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। নতুন বাংলা বছর তো শুরু হল সবে। চলুন, এই নতুন বছরে আমরা যাব এক নতুন ধরনের মেলায়। যেখানে যাব সেই জায়গাটার নাম শুনে কিন্তু নাক কুঁচকাবেন না কেউ। শহরটি উত্তর চব্বিশ পরগনার একটি অন্যতম সমৃদ্ধ এবং বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। শহরটির নাম গোবরডাঙা।

এর আগে আপনাদের আমি কাঁকড়া, মাছ, আলুর দমের মেলায় নিয়ে গিয়েছিলাম মনে আছে? সেসব রান্না করতে মশলা লাগবে তো নাকি? আজ নিয়ে যাব আপনাদের এমন একটা মেলায় যে মেলার চলতি নামই হল মশলা মেলা অর্থাৎ এই মেলার বিকিকিনির প্রধান উপকরণই হল মশলা। এই মেলার পোশাকী নাম হল "গোবরডাঙা গোষ্ঠবিহারী মেলা" কিন্তু এই মেলায় আসা ক্রেতা বিক্রেতাদের মুখে মুখে এর নাম "মশলা মেলা" হয়ে গেছে। চলুন, রওনা দেওয়া যাক গোবরডাঙার প্রায় ১৯৮ বছরের পুরনো এই মেলার পথে।

Gosthobehari1

বর্ধিষ্ণু এই শহরের একদিকে জমিদার বাড়ি, আরেকদিকে যমুনা নদীর ধার। এক সময় যমুনা নদী দিয়ে বড়ো বড়ো নৌকায় করে পশরা সাজিয়ে নিয়ে আসতেন ব্যবসায়ীরা। আর গোবরডাঙ্গা জমিদারবাড়ি সংলগ্ন মাঠে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখের দিন সূচনা হতো বা এখনো সূচনা হয় মশলা মেলার। যেখানে কৃষক, বড় ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, সাধারণ ক্রেতা সবাই জড়ো হন, পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র মশলা মেলায় যেখানে মশলাই হচ্ছে বানিজ্যের একমাত্র বস্তু।

গোবরডাঙা জমিদারবাড়ির সিংহদ্বার দিয়ে ঢুকে তার সামনে দাঁড়ালে সেখানকার ইট, কাঠ, পাথরই জানিয়ে দেবে এই মেলার গল্পকথা। কথিত আছে, গোবরডাঙার জমিদার ফেলারাম মুখার্জি দীর্ঘদিন নিঃসন্তান ছিলেন। পরবর্তীকালে দেবী প্রসন্নময়ী কালীর কাছে প্রার্থনা করে তার পুত্রসন্তান লাভ হয়।

Gosthobehari2

এরপর ফেলারাম কালীমন্দির ও দ্বাদশ শিব মন্দির নির্মাণ করবেন বলে ঠিক করলেন। তিনি শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেননি। তাঁর পুত্র কালীপ্রসন্ন কালীমন্দির ও শিবমন্দির নির্মাণের কাজ শেষ করে বাংলা ১২২৯ সালের পয়লা বৈশাখ মন্দিরে কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে যে রানী রাসমণি একবার এখানে এসেছিলেন।

জমিদার কালীপ্রসন্নই ১২৩০ বঙ্গাব্দে জমিদার বাড়ি সংলগ্ন মাঠে প্রথম এই মেলার সূচনা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এমন একটা মেলার প্রচলন যেখানে তাঁর প্রজা কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল এবং মশলা বিক্রিও করতে পারবেন, একইসঙ্গে দিতে পারবেন জমিদারের খাজনা। তার জন্য জমিদার কালিপ্রসন্ন বেছে নিয়েছিলেন বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটিকেই।

আদা, হলুদ, শুকনো লঙ্কা, রসুন, ধনে, পেঁয়াজ, জিরা, তিল, ডাল সব ধরণের মশলার পসরা সাজিয়ে বসেন দূর দূরান্ত থেকে আসা কৃষক বিক্রেতারা। বহু ব্যবসায়ী বস্তা ভর্তি করে পাইকারি দরে মশলা কিনে নিয়ে যান। এই মেলায় নজর কাড়ে মহিলা ক্রেতার সংখ্যা। গোটা বছরের জন্য রান্নাঘরের প্রয়োজনীয় মশলা কিনে নিয়ে যান তাঁরা।

Gosthobehari3

গতবছর অবশ্য মারণ ভাইরাসের আতঙ্কে বন্ধ ছিল এই মেলা। এই বছরে করোনা বিধি মেনে চালু হলেও মেলার কেনাকাটায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। নানারকম মশলার বস্তা একটার ওপর একটা থরে থরে সাজানো। কিন্তু ব্যবসা.... হয়ত জমতে একটু সময় লাগবে।

জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের এই স্বপ্নের মশলা মেলার উদ্দেশ্যে ছিল প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় এবং জমিদারির অর্থনীতির ভিতকে মজবুত করা। কিন্তু কালের নিয়মে এই মেলাই হয়ে উঠেছে গোবরডাঙা সহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলার অর্থনীতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। দশ দিন ধরে চলে এই মেলা।

তাহলে বন্ধুরা, মশলা মেলায় ঘুরে বেড়িয়ে ভাল লাগল তো? অপেক্ষায় থাকুন এবং সুস্থ থাকুন। আরও নতুন নতুন মেলায় যাওয়া বাকি রয়েছে এখনও।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...