বলছি কি বন্ধুরা, বাংলা বছর তো শেষ হয়েই এর। আর কয়েকটা দিন মাত্র আছে তারপরই বাংলা নববর্ষ আসবে। আমরা তাকে সাদরে বরণ করে নেব। কিন্তু নববর্ষ শুরুর ঠিক আগে একটা উৎসব পালন করা হয় আমাদের এই বাংলায় সেটার কথা কি আপনাদের জানা আছে? ঠিকই ধরেছেন বন্ধু, আমি রাঢ় বাংলার গাজন উৎসবের কথা বলছি।
চৈত্র সংক্রান্তিতে শিবের পুজো উপলক্ষে গাজনের মেলা বসে অনেক জায়গায়। তারমধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য বাঁকুড়ার দ্বারকেশ্বর নদের তীরে এক্তেশ্বরের গাজনের মেলা। চলুন, এবারের চৈত্র সংক্রান্তিতে আমরা বরং এক্তেশ্বরের গাজনের মেলাতেই যাই।
প্রথমেই গাজন উৎসব কী এবং কেন পালন করা হয় সেই নিয়ে বরং কয়েকটা কথা বলি। ছোটবেলায় শোনা বহুশ্রুত ছড়াটির কথা তো আমাদের সকলেরই মনে আছে। '‘আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই’'। ছড়াটির মধ্যে গ্ৰামবাংলার একটা রূপ ফুটে ওঠে না? শিবের গাজন – গ্রাম থেকে ‘গা’ আর ‘জন’ মানে জনগণ দেশগাঁয়ের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। গাজন বা চড়কপুজো সাধারণ মানুষের দেশের উৎসব, আপন উৎসব।
একটা বাংলা বছরের শেষ উৎসব হলো গাজন বা চড়ক উৎসব। চৈত্র মাসের শেষে ভগবান শিবের পূজা আরাধনা করার উদ্দেশ্যেই এই উৎসব বঙ্গদেশে উদযাপিত হয়। অনেকে আবার বলেন শিবের নামে সন্ন্যাসীরা যে জয়ধ্বনি করেন তা অনেকটা গর্জনের মত শোনায়। সেই "গর্জন" থেকেই গাজন শব্দটি এসেছে। যেটাই হোক না কেন চৈত্রের গাজন যে শিবের পূজা এবিষয়ে সবাই সহমত। আর এই গাজনকে কেন্দ্র করেই আজকের মেলা।
দ্বারকেশ্বর নদের তীরে অবস্থিত এক্তেশ্বর এবং ‘এক্তেশ্বর’ মহাদেবের মন্দিরের জন্যই এই জায়গা বিখ্যাত। শতাব্দী প্রাচীন বাঁকুড়ার এই শিব মন্দির। প্রতি বছর এই গাজনের সময় এখানে বিরাট মেলা বসে। এইসময়ে ভক্তদের সমাগমে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। উৎসব ঘিরে সরগরম হয়ে ওঠে গোটা অঞ্চল।
এক্তেশ্বর গাজন ‘চৈত্র মাস’-এর শেষ দিনে পালিত হয়। মানুষরা এখানে খুব উৎসাহ এবং আনন্দের সাথে চড়ক পূজা উদযাপন করে। মেলায় শিশুদের জন্য পুতুল, খাবার, মিষ্টি, স্থানীয় হস্তশিল্পের নিদর্শন এবং চড়কের বিভিন্ন স্টল বসে। এখানে গাজনের ১৫ দিন আগে থেকে শিবের ভক্তরা জড়ো হয়ে যান।
বহুযুগ ধরে ভক্তদের পূজা,পাঠের নিয়ম চলে আসছে। প্রতি বছর বাংলা বছরের শেষের তিনদিন এখানে গাজনের মেলা বসে। এই গাজনের আবার তিনটি ভাগ আছে। প্রথম দিন পাটস্নান, দ্বিতীয় দিন রাত গাজন ও তৃতীয় দিন দিন গাজন অনুষ্ঠিত হয়।
লক্ষাধিক মানুষ ও হাজার হাজার ভক্তের সমাগমে মেতে ওঠে বাঁকুড়া জেলার এক্তেশ্বর। বাঁকুড়া জেলার তো বটেই, সারা রাজ্য থেকেই শিবভক্ত মানুষ আসেন এই গাজনে যোগ দিতে। স্থানীয় মানুষদের মতে এই গাজন ৬০০ বছরেরও বেশি পুরনো।
আগে এই গাজন উপলক্ষে কিছু বীভৎস প্রথা প্রচলিত ছিল। যেমন শিবভক্তরা আগুনের উপর ঝাঁপ দিতেন, কাঁটার উপর ঝাঁপ দিতেন, একটি অজস্র লোহার গজাল বা পেরেকবিদ্ধ পাটায় প্রধান যে শিবভক্ত তাকে ঐ পেরেক বা গজালের উপর শুইয়ে মূল শিবমন্দিরে নিয়ে আসা হতো। ভক্তরা নিজেদের জিভে বা গায়ে লোহার শলাকা বিদ্ধ করতেন।
কিন্তু এখন এইসব প্রথা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখনও চড়ক উৎসব হয়। সন্ন্যাসীরা "হর হর ব্যোম ব্যোম" ধ্বনিতে শিবের জয়গান করেন। গর্জনে মুখরিত হয়ে ওঠে এক্তেশ্বর গাজন মেলা।
বন্ধুরা, ভাল লাগল এই গ্ৰামীন মেলায় ঘুরে বেড়িয়ে? আবার ক'দিন অপেক্ষা। নতুন মেলায় যাওয়ার জন্য মন-নদীতে ভেলা ভাসিয়ে দেব আমরা...