বাংলার মেলা: পূর্ব মেদিনীপুর মহিষাদল রথের মেলা

বন্ধুরা, আমরা তো ঠিকই করে নিয়েছি যে এই রিমঝিম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে পুরো আষাঢ় মাস জুড়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে আমরা দেখব বেশ কয়েকটি রথের মেলা। গত সপ্তাহে তো গিয়েছিলাম রানীগঞ্জ। এই সপ্তাহে যাব.... দাঁড়ান, আপনাদের একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি। আচ্ছা, আপনারা নিশ্চয়ই টেনিদার বিভিন্ন কাহিনী পড়েছেন? নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সৃষ্ট বাঙালির চিরকালের প্রিয় সেই অমর চরিত্র। আপনারা নিশ্চয়ই অবাক হয়ে ভাবছেন যে রথের মেলায় বেড়ানোর সঙ্গে টেনিদার কী সম্পর্ক? রহু ধৈর্যং বন্ধুগণ।

আজ আমরা যে ঐতিহ্যমণ্ডিত রথের মেলায় যাব সেই জায়গাটির নাম একটি মজার ধাঁধায় লিখেছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তার বিখ্যাত টেনিদা উপন্যাস "কম্বল নিরুদ্দেশ"-এ। এই কারণেই টেনিদার উল্লেখ। জায়গাটির নাম .... "নিরাকার মোষের দল"। মানে বুঝলেন না? আরে আমরা চলেছি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদল... যেখানকার রথযাত্রা অতি বিখ্যাত।

এমন কথাও প্রচলিত যে পশ্চিমবঙ্গের রথের মেলাগুলির মধ্যে খ্যাতির শীর্ষে হুগলির মাহেশের রথের পরই রয়েছে মহিষাদলের রথযাত্রা। রথের উচ্চতার দিক থেকে এটি পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সর্বোচ্চ, পুরীর জগন্নাথ দেবের রথের পরেই এর উচ্চতা। ভাবা যায়! তাহলে চলুন, রওনা দেওয়া যাক মহিষাদলের দিকে। কলকাতা থেকে দূরত্ব একশো কুড়ি কিলোমিটার মাত্র...

পৌঁছে গেছি মহিষাদল। আরে হোকই না মানস ভ্রমণ তাতে কি বেড়ানোর আনন্দ কিছু কম নাকি! চলুন, জেনে নেওয়া যাক এই রথযাত্রার ইতিহাস। পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম কয়েকটি রথযাত্রার অন্যতম হলো মহিষাদলের রথযাত্রা। সেই কত বছর আগে...দুশো পঁয়তাল্লিশ বছর...এই রথযাত্রা যাত্রা শুরু সেই ১৭৭৬ সালে (মতান্তরে ১৭৬৬)। পাঁচতলা এই কাঠ নির্মিত রথের মোট ১৩টি চূড়া রয়েছে। এই রথের চাকার সংখ্যা ৩৬।

MahishadolRatha1

প্রত্যেক তলায় চারপাশে ঘুরবারান্দা রয়েছে। রথের দ্বিতীয় তলায় ৪ জন কাঠের রক্ষী দেখা যায়, তাদের হাতে থাকে বর্শা। প্রচলিত রয়েছে যে বর্শাগুলি ইংল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল, কারণ একমাত্র ইংল‌্যান্ডের উইন্ডসর ক্যাসেলেই রক্ষীদের হাতে এই ধরনের বর্শা দেখা যেত। সেইদিক দিয়ে বিচার করলেও এই রথ একটি অন্যতম দর্শনীয় বস্তু। আর পঞ্চম তলে বা সর্বোচ্চ তলায় বিগ্রহের পাশে খোলা তরোয়াল হাতে একজন রক্ষী দাঁড়িয়ে থাকেন।

প্রচলিত রয়েছে যে মহিষাদলের রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায়ের পত্নী রানি জানকী ১৮৭৬ সালে এই রথযাত্রার সূচনা করেন। কথিত আছে, এক দিন একদল প্রজা এসে রানি জানকীর কাছে আবেদন জানান পুরীর মতো মহিষাদলেও রথযাত্রা চালু করা হোক। প্রজাদের আবেদনে সাড়া দিলেন প্রজাবৎসলা রানী মা। মহিষাদলে শুরু হল রথযাত্রা।

ঐতিহ্যবাহী এই রথযাত্রায় রথে কিন্তু জগন্নাথ দেবের সঙ্গী তাঁর দাদা এবং বোন নন, অধিষ্ঠিত হন রাজবাড়ির কুলদেবতা মদনমোহন জিউ এবং দেবী রাজরাজেশ্বরী। বলরাম বা সুভদ্রার কোনও প্রতিকৃতি রথে থাকে না। সারা বছর এই রথ দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন এখানকার রাজ পরিবার। তবে বর্তমানে রথ উৎসবের দিনগুলিতে মেলা ও তার আনুসঙ্গিক সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সমস্ত খরচ ও পরিচালনার দায়িত্ব বহন করে স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতি।

রথ টানার ক্ষেত্রে এখনও সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও প্রথা মেনে চলা হয়। আগে হাতির পিঠে চড়ে রাজা বাহাদুর যেতেন রথযাত্রার উদ্বোধনে কিন্তু বর্তমানে রাজ পরিবারের বর্তমান সদস্য পালকি চড়ে রাজবাড়ি থেকে রথযাত্রার উদ্বোধন করতে যান। সঙ্গে থাকেন রাজাবাহাদুরের রূপার বর্শাধারী দেহরক্ষী, মাথার উপর রাজছত্র।

জনা পঞ্চাশেকের এক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও থাকে সঙ্গী হয়ে। পালকি থেকে নামার আগেই ডঙ্কা বাজিয়ে ঘোষণা করা হয় রাজামশাইয়ের আগমনবার্তা। তিনিই রীতিনীতি মেনে পালন করেন সূচনার মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। তারপর টান দেন রথের রশিতে। তোপধ্বনি দিয়ে শুরু হয় রথের মাত্রা। এরপরে অন্ততপক্ষে হাজার দশেক মানুষের টানে গড়গড় করে এগিয়ে চলে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই রথ। রথে চারটি রশি যার মধ্যে একটি শুধু মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট থাকে।

রথযাত্রা উপলক্ষে বসে বিশাল মেলা। এই মেলায় সবথেকে বেশি বিক্রি হয় কাঁঠাল। সার দিয়ে বসে কাঁঠাল, বেতের সামগ্রী, জিলিপি, পাঁপড়, তেলেভাজার দোকান। আর বসে প্রচুর সুগন্ধির দোকান। এটা এই মেলার বিশেষত্বও বটে। পাশাপাশি, মেলায় যেমন মাছ ধরার জাল ও বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হয় তেমনি বিক্রি হয় কৃষি কাজের সহযোগী বিভিন্ন জিনিসপত্র।

আর একটা জিনিসের কথা অবশ্যই বলতে হবে, যেটা না খেলে বা যেটা সম্পর্কে না বললে অপরাধ হয়.. সেটা হল মিহিদানা, যা নিয়ে বর্ধমানের সুনাম বা অহঙ্কার থাকলেও মহিষাদল কিন্তু তাকে কড়া প্রতিযোগিতার মুখে ফেলতে পারে এমনই এই মিঠাইয়ের স্বাদ। বাকি মনোহারী সামগ্ৰী তো আছেই। লক্ষাধিক মানুষ আসেন এই রথযাত্রা এবং মেলা দর্শনের উদ্দেশ্যে।
তাহলে বন্ধুরা, মহিষাদল রথ দর্শন আজ এখানেই শেষ করি? পরের সপ্তাহে আবার আরেকটা মেলা...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...