বুঝলেন বন্ধুরা, মধ্যম পাণ্ডবকে আমি ভারি পছন্দ করি। মধ্যম পাণ্ডব কে তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। বাঙালিরা মহাভারতের কাহিনী জানবেন না সে কি হয়! ঠিক ধরেছেন, আমি মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবের দ্বিতীয় অর্থাৎ ভীমসেনের কথা বলছি।
মহারাজ পাণ্ডুর এই দ্বিতীয় পুত্রটি যেমন বীর যোদ্ধা ছিলেন তেমনই মাতৃভক্ত ছিলেন, পাশাপাশি প্রেমিক বা স্বামী হিসেবেও অনন্য এবং পাচক হিসেবেও অতুলনীয় ছিলেন। আর এই গুণটাই আমাকে সবথেকে বেশি আকৃষ্ট করে। রান্না করতে আর খেতে যারা ভালোবাসেন তাদের সঙ্গে নিজের বড্ডো বেশি সাদৃশ্য খুঁজে পাই কিনা।
তা এই ভীমসেন তো শুধু আমারই প্রিয় নন, লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করেন, ভক্তি করেন, ভালোবাসেন এবং তাঁকে দেবতা রূপে পূজা করেন। হ্যাঁ পাঠকবন্ধুরা, আজ আমি যে মেলা নিয়ে লিখতে চলেছি, বলা ভালো যে মেলায় আমরা মনে মনে বেড়াতে যাব সেই মেলাটির নামই মধ্যম পাণ্ডবকে কেন্দ্র করে - ভীম মেলা। ভীমসেনের পুজো উপলক্ষ্যে এই মেলার আয়োজন করা হয়। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকের কাছে কুলবেড়িয়া গ্রামে ভীম একাদশী তিথিতে ভীমপূজা উপলক্ষ্যে বসে ভীম মেলা।
এবার আলোচনা করি এই ভীম একাদশী তিথি কবে এবং কেন পালন করা হয় তা নিয়ে। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিকে বলা হয় ভীম একাদশী বা ভৈমী একাদশী। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী বনবাসের সময় এক মাঘ মাসের শুক্ল একাদশী তিথিতে পাণ্ডবমাতা কুন্তী ভোরবেলা এক জলাশয়ে স্নান করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু জল এত ঠাণ্ডা ছিল যে কুন্তীর খুব কষ্ট হচ্ছিল। ভীমসেন ছিলেন অত্যন্ত মাতৃভক্ত।
মা'র কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। তিনি একটি লাঙলের ফাল খুলে নিয়ে আগুনে তীব্র গরম করে "জয় কৃষ্ণ" বলে জলাশয়ের জলে ডুবিয়ে দিলেন। জলাশয়ের জল মুহূর্তে বেশ উষ্ণ হয়ে উঠলো এবং কুন্তী বেশ আরাম বোধ করলেন। কিন্তু পুকুরের জল অত গরম হয়ে যাওয়াতে জলের দেবতা বরুণদেবের সারা শরীরে জ্বালা ধরে গেল। তিনি গিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে অনুরোধ করলেন এর বিহিত করতে।
শ্রীকৃষ্ণ তখন বলেন যে ভীমসেন যদি মাঘ মাসের শুক্লা একাদশীর দিন যদি উপবাস করে ব্রত পালন করেন তাহলে বরুণ দেবের জ্বালা উপশম হবে। ভীমসেন তো রাজপুত্র। তার উপর অতি সদাশয়। ভীমকে এসে বরুণ দেব অনুরোধ করাতে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ব্রত পালনে রাজি হয়ে গেলেন। দূর হলো বরুণ দেবের শরীরের জ্বালাপোড়া। তখন থেকেই শুরু হলো ভীম একাদশী তিথি পালন।
কাশিরাম দাসের মহাভারতে উল্লেখ করা আছে যে বনবাসের সময় পাণ্ডবরা কিছুদিন দক্ষিণ বঙ্গের জেলাগুলোতে বসবাস করেছিলেন। আর দক্ষিণ বঙ্গেই কয়েকটি জেলায় ভীমসেনকে দেবতা রূপে পূজা করা হয় এই ভীম একাদশী তিথিতে। আর মেদিনীপুরের কুলবেড়িয়া গ্ৰামে ভীমসেনের বিশাল মূর্তি স্থাপন করে বিশাল ধূমধাম সহকারে পূজা এবং মেলা হয়।
তাঁর দাড়িগোঁফ সহ দশাশই মূর্তি যেন প্রবল পৌরুষের প্রতীক। ভীমসেনের মূর্তিতে পরিয়ে দেওয়া হয় অজস্র মালা। তারমধ্যে ফুলের মালা, সোনার হার এমনকি টাকা দিয়ে তৈরি বেশ কয়েকটি গলার মালাও থাকে। প্রচুর মানুষ আসেন ভীমসেনকে পুজো দেওয়ার জন্য এবং দর্শন করার জন্য। বহু মানুষ তাদের নানান মনোবাসনা জানান ভীমের কাছে এবং মনোস্কামনা পূর্ণ হওয়ার পর বহু মানুষ এখানে ছোট ছোট ভীমের মূর্তি বসিয়ে দিয়ে যান। দেখবার মতো সুন্দর করে মন্দির ও মূর্তি সাজানো হয়।
মেলাটিও অন্ততঃ একশো কুড়ি বছরের পুরনো। ভীমসেনের মূর্তির মতোই বিশাল মেলার আয়োজনও। প্রচুর মানুষ আসেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলা থেকে এবং অন্যান্য জেলা থেকেও। আট দশ দিন ধরে চলে এই মেলা। বাংলার কিছু প্রায়-অবলুপ্ত শিল্প সংস্কৃতির নিদর্শন মেলে এই ভীম মেলাতে। যেমন পুতুল নাচের মতো একটি অপূর্ব সুন্দর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পেরেছেন এই মেলার সংগঠকরা। পাশাপাশি নাগরদোলা, কাঁচের চুড়ি, পুতুল, শঙ্খের জিনিস এগুলোর তো পাওয়া যায়ই। ক্রেতা, বিক্রেতা, ভক্ত, দর্শক সবাই খুশি। আমরাও খুশি।
আজকের মেলা দেখা এখানে শেষ করি। মেলা থেকে কেনা গরম জিলিপিগুলো (যদিও মনে মনে) খেতে হবে না? না খেলে কিন্তু ভীমসেন ভারি রাগ করেন।
আমার পাঠকবন্ধুরা, সবাই ভালো থাকবেন। অনেক অনেক বেড়ানো বাকি আছে কিন্তু।