লাভপুর - নামটা শুনলেই কার কথা মনে পড়ে বলুন তো? মনে পড়ছে না? সেই বিখ্যাত মানুষটি প্রথম জ্ঞানপীঠ জয়ী বাঙালি সাহিত্যিক। সুবিখ্যাত বন্দ্যোপাধ্যায় ত্রয়ীর অন্যতম তিনি। ঠিক ধরেছেন, তাঁর নাম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। বীরভূমের লাভপুর ছিল তাঁর জন্মস্থান এবং তাঁরা সেখানকার জমিদার ছিলেন।
সত্যি কথা বলতে কী আজ যেই মেলায় আমরা সবাই মিলে বেড়াতে যাব সেই মেলার নাম প্রথম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি প্রবন্ধ থেকে জানতে পারি। মেলাটির নাম লাভপুর ফুল্লরার মেলা। আজ আমি পাঠক বন্ধুদের নিয়ে যাব লাল মাটির দেশ বীরভূম। সেই বীরভূমের লাভপুরে আছে একটি সতীপীঠ, দেবী ফুল্লরার মন্দির।
আর এই দেবীর পূজাকে কেন্দ্র করেই বসে ফুল্লরার মেলা। কিন্তু এই মেলায় যেতে হলে আমার সঙ্গে চড়ে বসুন টাইম মেশিনে। হুশ করে চলে যাচ্ছি আমরা পিছন দিকে....মাঘ মাসের পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। আকাশ জোড়া আলোয় ভেসে যাচ্ছে লাভপুর। একটু দূরেই আছে হাঁসুলিবাক যাকে অমর করে দিয়েছেন তারাশঙ্কর তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস "হাঁসুলিবাঁকের উপকথা"য়।
আর এই মাঘী পূর্ণিমার দিনই শুরু হয় ফুল্লরার মেলা। ছবির মত সুন্দর ছোট্ট স্টেশন লাভপুর। আর স্টেশন থেকে খুব কাছেই অসংখ্য তেঁতুল গাছের ছায়া বেষ্টিত মা ফুল্লরার মন্দির। পুরাণ মতে এটি একান্ন সতীপীঠের অন্যতম - এখানে দেবী সতীর ওষ্ঠ অর্থাৎ ঠোঁট পতিত হয়েছিল। তাই হিন্দুদের কাছে এটি অতি পবিত্র স্থান। লাল কাঁকুরে মাটির টিলা।
তার উপরে পীঠভূমি। নীচ দিয়ে তির তির করে বয়ে চলেছে কোপাই নদী। কাছেই মহাশ্মশান। মনোরম পরিবেশে মন্দিরটি অবস্থিত। এখানে দেবীর ভৈরব হলেন বিশ্বেশ্বর মহাদেব। তিনি এইখানেই একটি আলাদা ছোট মন্দিরে অবস্থান করেন। দেবীর কোন বিগ্ৰহ নেই। মূল মন্দিরের ভিতরে একটা কচ্ছপের পিঠের মতো বড় শিলা রয়েছে।
এই শিলাখন্ডটি রক্ত বস্ত্রাবৃত এবং সিঁদুর মাখা। এই পাথরকেই দেবী মায়ের প্রতিভু রূপে পূজা করা হয়। পাথরটিকে ভালো করে খেয়াল করলে তার সামনের ভাগটা ঠোঁটের আকৃতির মতো মনে হয়। জয় দুর্গা মন্ত্রে দেবী ফুল্লরার নিত্য সেবা হয়। তন্ত্রচূড়ামণি গ্ৰন্থে এই ফুল্লরা সতীপীঠের উল্লেখ আছে। মন্দির থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে এক বিশাল দীঘিতে যে দীঘির নাম দেবীদহ।
প্রবাদ আছে এই দীঘির জল নাকি কখনো শুকোয় না। কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে যে শ্রীরামচন্দ্র যখন দেবী দুর্গার অকালবোধন করেছিলেন তখন হনুমান এই দেবীদহ দীঘি থেকে ১০৮টি নীলপদ্ম সংগ্ৰহ করে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিদিন দেবীর ভোগে থাকে ভাত ডাল তরকারি এবং মাছের টক।
আগে এই অঞ্চলে জঙ্গল ছিল এবং সেখানে শিয়াল থাকত প্রচুর। দেবীর ভোগ শিয়ালকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা ছিল। সেই শিবাভোগ (শিবা অর্থ শিয়াল) বেদী এখনও রয়েছে যদিও এখন আর শিয়াল নেই এই এলাকায়। মন্দিরের ভিতরে রয়েছে পঞ্চমুণ্ডির আসন।
প্রচলিত জনশ্রুতি এই যে কৃষ্ণানন্দ গিরি নামে এক সাধক কাশির মণিকর্ণিকা ঘাটে ঈশ্বর সাধনা করতেন। এক মাঘী পূর্ণিমায় দেবী ফুল্লরা তাকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন যে তাঁকে দেবীর পীঠস্থান লাভপুরে এসে দেবী ফুল্লরার মাহাত্ম্য প্রচার করতে হবে এবং দেবী ফুল্লরাকে দুর্গা মন্ত্রে আরাধনা করতে হবে।
তিনি তখন বহু দুর্গম পথ ধরে পায়ে হেঁটে লাভপুরে আসেন, দেবী ফুল্লরাকে দুর্গা রূপে পূজা করেন এবং মহাষ্টমীর সন্ধিক্ষণে সিদ্ধি লাভ করেন। মাঘী পূর্ণিমায় দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন বলে সেই তিথিতে প্রত্যেক বছর এখানে মেলা বসে যে মেলার নাম ফুল্লরা মেলা।
প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমায় এখানে পনের দিন ধরে বিশাল মেলার আয়োজন করা হয়। ১৩০৬ বঙ্গাব্দে ৩রা ফাল্গুন প্রথম ফুল্লরা মেলা বসেছিল। বীরভূম জেলার অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহৎ মেলা এটি। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলা এবং রাজ্যের বাইরে থেকেও প্রচুর মানুষ আসেন এই মেলায়। একশো একুশ-বাইশ বছরের পুরনো এই মেলায় সাড়ে চারশোর বেশি স্টল বসে। বাউল গানে এবং দেবীর মন্ত্রে মেতে ওঠে মন্দির প্রাঙ্গন। প্রসঙ্গত এই নতুন মন্দিরটি ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করিয়ে দিয়েছিলেন জমিদার রাঘব লাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
কত রকমের মনোহারী দোকান বসে এই মেলায়। পুতুল, মূর্তি, কাঠের জিনিস পত্র, খেলনা, বিভিন্ন লোভনীয় খাবার… সব দোকানেই উপচে পড়া ভিড়। ভক্তরা মা ফুল্লরার দর্শন করেন, পুজো দিয়ে এবং বিশ্বেশ্বর মহাদেবকে প্রণাম করে মেলায় মনের আনন্দে বেড়িয়ে, কেনাকাটা করে, বাউলগান শুনে ফিরে যান নিজের ঘরে। প্রচলিত বিশ্বাস এই যে মন্দিরের হাঁড়িকাঠের নীচের মাটি গায়ে মাখলে কুষ্ঠ রোগীরও রোগ নিরাময় হয়।
আমাদের মানস-ভ্রমণও শেষ। পাঠক বন্ধু, আমরা পরের সপ্তাহে নতুন মেলায় যাওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হতে থাকি, কেমন!