বাংলার মেলা: ব্রহ্মদত্যির মেলা

আমাদের দেশ ভারতবর্ষে বা আমার নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে যে কোন মেলা শুধুমাত্র মেলাই নয়– মেলা এখানে মানুষের প্রাণের উৎসব। আনন্দে বেঁচে থাকার আহ্বান জানান এক মহোৎসব হল আমার বঙ্গদেশের মেলাগুলি। আমাদের জীবনে প্রতিদিনের অভাব অনটন দারিদ্র্য রোগ ব্যাধির চোখরাঙানি তো রয়েছেই। এগুলো যেন একটা খাঁচা হয়ে ঘিরে থাকে আমাদের দৈনন্দিন যাপনকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের এই খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকতে হয় দিনের পর দিন।

কিন্তু সারা মাস, বছর বা জীবন কি থাকতে ইচ্ছে করে এই খাঁচার ভিতর? বছরের কয়েকটা দিন তো ভাঙতে ইচ্ছে করেই এই খাঁচাটাকে। আর সেই দিনগুলোতেই আমরা একে অপরের সঙ্গে মিলন উৎসবে মেতে উঠি। এই আনন্দে, খুশিতে, ধনী দরিদ্র জাতপাত সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়াই হল মেলা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়..."ছোট আমি নয়, বড় আমির মধ্যে নিজেকে অনুভব করা, নিজের প্রাণের মধ্যে সমস্ত মানুষকে পাওয়া।"

তাই... এই প্রাণের উৎসবে প্রাণের টানে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে আমরা ঘুরে বেড়াব বাংলার শহরের ও গ্ৰামের বড় ছোট সব রকমের মেলায়। হোক না হয় মানস ভ্রমণ তাতে কী? বেড়ানোর আনন্দ অনুভব করতে বাধা কোথায়?

BrahmadatyiFair1

এইবার আমরা যে মেলাটায় যাব সেই মেলার নামটা দারুন মজাদার। আমার পাঠক বন্ধুদের মধ্যে যারা ভূতে বিশ্বাস করেন বা ভয় পান তারা চোখ বন্ধ করে ফেলুন। কারণ এই মেলার নাম হল....... ব্রহ্মদত্যির মেলা… নগরী, বীরভূম। গ্ৰামের নাম নগরী... কী মজার তাই না? আবার মেলাও কোন দেবদেবীর নামে নয়, ভূতেদের মধ্যে দেবভূত ব্রহ্মদত্যির নামে। আকারে বা পরিচিতিতে হয়ত তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, কিন্তু এই মেলা ঘিরে স্থানীয় মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনার কমতি নেই।

প্রতি বছর মাঘ মাসের প্রথম দিন এই মেলা বসে। মাত্র একদিনের জন্যই এই মেলার আয়োজন করা হয়। বীরভূম জেলার সদর শহর সিউড়ি থেকে আট দশ কিলোমিটার দূরে নগরী গ্ৰাম। সিউরি থেকে বাসে আমাদের পৌঁছে দেবে নগরী মোড় বাসস্টপে। সেই বাস স্টপ থেকে রাঙামাটির পথ ধরে হেঁটে বা অন্য কোনো যানে চেপে পৌঁছে যাওয়া যাবে এক সময়ের বর্ধিষ্ণু গ্ৰাম নগরীতে।

গত শতকের আশির দশকেও এই অঞ্চলে যানবাহন বলতে ছিল গরুর গাড়ি। সারি দিয়ে গরুর গাড়ি আসত নানান পশরা নিয়ে। গরুর গাড়ি এখনও এই এলাকায় মাল পরিবহনের জন্য চলাচল করে তবে সংখ্যায় কম। কেমন মজার হয় বন্ধুরা যদি আমরা গরুর গাড়ি চেপে মেলায় যাই? লাল মাটির রাস্তা ধরে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে গরুর গাড়ি বয়ে নিয়ে আসে মাটির নানা আসবাবপত্র, বাসনকোসন, পুতুল, মুড়ি ভাজার খোলা, গরুকে খাবার দেওয়ার বড় গামলা বা পাতনা।

নগরী গ্ৰামের ভিতর দিয়ে চওড়া লাল মোরাম বিছান রাস্তা পৌঁছে যায় বিশাল বটগাছ এবং নানান গাছে ঘেরা ব্রহ্মদত্যির থানে। স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস এই বটগাছে বাস করেন অথবা বাস করতেন। কথিত আছে যে ১৮৮২-৮৩ সাল বা ঐরকম সময়েই ব্রহ্মদত্যির থানে বটগাছের নীচে আস্তানা বানিয়ে থাকতে শুরু করেন এক সাধু। জায়গাটি তখন বেশ নির্জন ছিল। গ্ৰামীণ মানুষদের দেব দ্বিজে ভক্তি ছিল বেশি। তারা ঐ সাধুর আস্তানায় পুজো দিতে, মানত করতে আসা শুরু করল। ১৮৮৮–৮৯ থেকে শুরু হয়ে গেল মেলা। তখন থেকেই ব্রহ্মদত্যির থানে মেলার প্রচলন শুরু হয়ে যায়।

BrahmadatyiFair2

রাঢ় বাংলার এই মেলায় পুজো দেওয়ার সময় বা মানত করার সময় মাটির ঘোড়া দেওয়ার প্রচলন আছে। নগরী বা আশেপাশের গ্ৰামের ছোটখাট ব্যবসায়ীরা কেউ কেউ মাটির ঘোড়া তৈরি করে,পুড়িয়ে বিক্রি করতে নিয়ে আসেন এবং ফুল বেলপাতা, ফল, চাঁদমালা ইত্যাদির পাশাপাশি পুজোর উপকরণ হিসেবে বিক্রি করেন। মানুষ এসে এই থানে পুজো দিয়ে পোড়ামাটির ঘোড়া উৎসর্গ করেন।

জনশ্রুতি আছে এই থানে কেউ রাত্রিবাস করতে পারে না। বহু দুঃসাহসী মানুষ এই থানে রাতে থাকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। মেলাটি কলেবরে বেশ কিছুটা বড় হওয়ার পর স্বল্প পুঁজির দোকানদারদের কথা ভেবে মেলাটির স্থায়িত্ব বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বেশ কয়েকবার। কিন্তু প্রত্যেকবারই নাকি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। তাই এই মেলা একদিনের মেলা হিসেবেই রয়ে গেছে।

দুপুর এগারটার পর মেলায় ভিড় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। প্রাচীন মানুষরা বলেন আগে নাকি এই মেলায় সোনার দোকানও বসত কিন্তু চুরি ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন আর স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা আসেন না। রাঙা ধুলো গায়ে মাথায় মেখে হৈ হৈ করে চলে বেচা-কেনা। সন্ধ্যা হতে না হতেই ব্যবসায়ীরা দোকানপাট গুটিয়ে নেন। আঁধার ঘনিয়ে আসার আগেই ঘরে ফেরার পথে রওনা দেন সবাই।

পাঠক বন্ধুগণ, সশরীরে ব্রহ্মদত্যির দর্শন পেলে সেটা কিন্তু বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার হবে তাই না? চলুন না, মনে মনে দেখেই আসি দত্যি বাবাজীকে। যাওয়ার সময়ও মাস্ক পরতে ভুলবেন না কিন্তু...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...