বাংলার মেলা: বনবিবির মেলা

আমরা সবাই জানি "মেলা" শব্দটির একটি অর্থ মিলিত হওয়া। অনেক মানুষের মধ্যে নিজেকে মিলিয়ে দেওয়া অথবা নিজেকে খুঁজে পাওয়া... তার মধ্যেই মেলার সার্থকতা নিহীত আছে। বেশিরভাগ মেলার উৎস কোনো প্রতিষ্ঠিত বা কল্পিত দেবতার পূজা আরাধনা। এই মেলাগুলো নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে হয়ে থাকে।

এই ধরণের মেলাকে পূজা বা উপাসনাকেন্দ্রিক মেলা বলা হয়। আসলে মানুষ তো প্রকৃতির উপরেই নির্ভরশীল তার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের জন্য। কিন্তু প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায়ই হয় বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, ঝড় ইত্যাদি দুর্যোগ। আবার জীবিকার প্রয়োজনে মানুষকে যেতেই হয় দুর্গম বিপদসংকুল অরণ্যে অথবা সমুদ্রে অথবা পাহাড়ে।

এই কল্পিত দেবদেবীর পুজো আরাধনাও মূলত করা হয় প্রকৃতিকে তুষ্ট করার জন্য এবং ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যই। এমনই একটি মেলায় আজ পাঠকবন্ধুদের নিয়ে যাবো আমি। এই মেলা হলো দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার চাঁপাতলা বনবিবির মেলা। এই মেলাটি একটি প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী মেলা‌।

BonbibiFair1

বিদ্যাধরী নদীর একটি শাখা পিয়ালী নদী। এই পিয়ালী নদীর তীরে বনবিবির প্রাচীন থানটি অবস্থিত। শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন থেকে দক্ষিণ শাখার ক্যানিংগামী ট্রেনে পিয়ালী স্টেশনে নেমে বনবিবির থানে যাওয়া যায়। একটি অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় অবস্থিত এই থান। হিন্দু মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষেরই দেবী বনবিবি।

তাই এই দেবীর পূজা আরাধনা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি আশ্চর্য সুন্দর উদাহরণ। প্রকৃতপক্ষে বনবিবির পুজো কোনো সম্প্রদায় বিশেষের ধর্মীয় উৎসব নয়, যে সমস্ত মানুষরা জীবন জীবিকার জন্য সুন্দরবনের জঙ্গলের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল তাঁরাই দেবীর প্রধান সেবক।

বনবিবিকে সাধারণত জঙ্গলের বিপদনাশিনী দেবী রূপে কল্পনা করা হয় কিন্তু দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের কাছে এই দেবী শস্যদাত্রী, পশুপাখি রক্ষক, রোগহারিনী, সম্পদদাত্রী, ভূমিলক্ষ্মী এমনকি শিশুরক্ষাকারিনী রূপেও পূজিতা হন। মা বনবিবির ভক্তরা অসুখ বিসুখ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য দেবীর থানে মানত করেন এবং রোগমুক্তি ঘটার পর দেবীকে বাতাসা দিয়ে, এমনকি বুক চিরে রক্ত দিয়েও পুজো দেন।

BonbibiFair2

সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে জঙ্গলে কাঠের জন্য, মধু আনতে বা মাছ ধরতে যাওয়ার আগে সমস্ত ধর্মের মানুষ বনবিবির আশির্বাদ প্রার্থনা করে যান। সুন্দরবন--যেখানে বাস করে মানুষখেকো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার– সেই সুন্দরবনে যাদের জীবিকার তাগিদে যেতেই হয় তারা বিশ্বাস করেন জঙ্গলে তাদের ত্রাণকর্ত্রী বনবিবি ছাড়া আর কেউ নেই।

এবার আসি মেলায়। প্রত্যেক বছর ১ মাঘ চাঁপাতলায় বসে বনবিবির মেলা। এই বনবিবির থান অতি (২০০ থেকে ২৫০ বছরের) প্রাচীন এবং বনবিবির মেলাও বহু পুরনো। এই মেলার বৈশিষ্ট্য হলো ঘুড়ি ওড়ানো। এই দিনে যুবক ও কিশোর ছেলেরা ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দে মেতে ওঠে। ঘুড়ির প্যাঁচ খেলার রোমান্টিক টানে বহুদূর থেকে প্রতিযোগী ও দর্শকদের ভিড়ে মেলা প্রাঙ্গণ ভরে ওঠে।

এই চাঁপাতলা বনবিবির মেলায় কলকাতার কাছাকাছি অন্যান্য মফস্বলের মেলার মতোই মিশ্র সংস্কৃতি বা শহুরে সংস্কৃতিকে অনুকরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই অঞ্চলটি কলকাতা থেকে মাত্র আটচল্লিশ কিলোমিটার দূরে। তাই শহরের প্রভাবও খুব দ্রুত পড়ছে এই ঐতিহ্যবাহী মেলায়। যদিও গ্ৰামীন সংস্কৃতি ধরে রাখার প্রচেষ্টা রয়েছে মেলার কর্তাদের।

BonbibiFair3

মেলা উপলক্ষে ১মাঘ বিনোদনের বিভিন্ন প্রকার আয়োজন থাকে। দিনের বেলায় ঘুড়ি ওড়ানো, রাতে গান, নাটক, যাত্রা ইত‌্যাদির ব্যবস্থা থাকে। এই দেবীর পূজার কোনো বিশেষ মন্ত্র নেই। ভক্তরা ধূপবাতি জ্বেলে ফলমূল, বাতাসা, সন্দেশ ও দক্ষিনা দিয়ে দেবীর আরাধনা করেন। মুসলমান ভক্তরা নমাজের কলমা পড়ে "দোয়াদরিত" প্রার্থনা করেন।

মেলায় লোহার কৃষি যন্ত্রপাতি, গৃহস্থালির নানান জিনিস, রেডিমেড জামাকাপড়, মাছ ধরার সরঞ্জাম, খেলনা, সাজগোজের জিনিসপত্র, গয়না, মিষ্টি, ফুচকা, ঘুগনি, আলুর দম, তেলেভাজা, চপ ইত্যাদির দোকান বসে। (আহা, ফুচকার নামেই জিভে জল এসে যাচ্ছে না? খেয়েই নিই কটা। মনে মনে যদি মেলায় বেড়াতে পারি তাহলে মনে মনে ফুচকা ঘুগনি খেতে অসুবিধা কোথায়?)

এই উপাসনাকেন্দ্রিক মেলায় সমাজ বিবর্তনের টুকরো টুকরো ছবি প্রত্যক্ষ করা গেলেও স্থানীয় মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনার কারণেই এবং গভীর বিশ্বাসেই দেবী বনবিবির থানের ঐতিহ্য পূর্ণ রূপে বজায় রয়েছে।

পাঠকবন্ধুরা, আজকে মেলা ভ্রমণ এখানে শেষ করি? নতুন নতুন আরো কতো মেলায় যাওয়া বাকি রয়েছে এখনো... সবাই ভালো থাকুন কিন্তু।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...