বাংলার মেলা: পুরুলিয়ার বেড়োর খেলাই চণ্ডী মেলা

জানেন, চারপাশের পরিস্থিতি দেখে আমাদের কারুরই মন ভালো নেই। কিন্তু নিজেকে তো নিজেদেরই ভাল রাখতে হবে। শরীর বা মন পুরোটা ভালো রাখা যদি আমাদের হাতে নাও থাকে কিন্তু কিছুটা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব। সেটুকুই না হয় চেষ্টা করি আমরা। এই যে আমি বিভিন্ন মেলা নিয়ে লিখি.... সেটাও কিন্তু অনেকটাই সেই কারণেই।

আমরা তো সকলেই জানি এই মুহূর্তে ঘরের মধ্যে থাকাটাই নিরাপদ থাকার সবথেকে ভালো পন্থা কিন্তু মনটা তো চায়ই "দূরে কোথাও দূরে দূরে" হারিয়ে যেতে। তাই সশরীরে না হোক, মনে মনে তো আমরা যেতে পারিই কোন না কোন অদেখা অজানা জায়গায়... যেখানে হয়ত আছে একটা টিলা বা ছোট পাহাড়‌। নীচ দিয়ে তির তির করে বয়ে চলা একটা মিষ্টি নদী। অথবা পাহাড়ের গা দিয়ে ঝুম ঝুম করে নূপুর বাজিয়ে নেমে আসা একটা হাসিখুশি ঝর্ণা।

kheraichandi1

অনেকগুলো গাছ আছে সেখানে। কত জানা অজানা ফুল ফুটেছে। গাছের ছায়ায় বসে আছি আমরা। আর সেখানে হয়তো ছোট্ট একটা মন্দির আছে… হয়ত.. গ্ৰামের মানুষজন আসেন সেখানে সারা বছর পুজো দিতে। আর কোন এক বিশেষ দিনে আশেপাশের গ্ৰাম থেকে প্রচুর মানুষ এসেছেন কোন গ্ৰামীন দেবদেবীর উপাসনা উপলক্ষে আর সেখানেই সন্ধ্যাবেলা বসেছে একটা ছোট্ট মত মেলা। সেই মেলায় পাওয়া যায় মাটির পুতুল, কাঠের পুতুল, ঘরকন্নার খুঁটিনাটি জিনিসপত্র।

বাড়ির ছেলেমানুষ সদ্য বিয়ে হয়ে আসা বৌটি সেখানে চুপিচুপি সবার কান বাঁচিয়ে তার ভালবাসার মানুষটির কাছে কাঁচের চুড়ি কিনে দেওয়ার জন্য আবদার করে। সংসারের গৃহিনী দরদাম করে কেনেন বেলুন চাকি, লোহার কড়াই, স্টিলের বাসন অথবা সস্তার কাপ ডিশ। দেখে শুনে হয়তো কিনে নেন ছোট একটা ঠাকুরের সিংহাসন যেখানে তিনি রাখবেন লক্ষ্মীর পট বা তাঁর সাধের গোপালকে।

একটা মাঝারি সাইজের জলচৌকি যেটা হয়তো সম্পন্ন পরিবারের বড় কর্তাটি দাওয়ায় বা বারান্দায় পেতে তার উপর বসে তার ধানের গোলায় কাজ করতে আসা মজদুরদের কাজকর্ম দেখাশোনা করবেন অথবা গিন্নি মা সেই চৌকিতে বসে সংসারের সব কাজ পর্যবেক্ষণ করবেন।

kheraichandi2

নতুন কড়াইতে মাছ ভাজবে বাড়ির বড় বৌ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের মায়ের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করবে একটা কাঠের বন্দুক, লম্বা একটা বাঁশি, বল বা সুন্দর সুন্দর পুতুলের, চুড়ি, পুঁতির মালা, খেলনাবাটি কিনে দেওয়ার বায়না করে। কাঠের নাগরদোলায় চড়ে অকারণ হাসিতে গড়িয়ে পড়বে কিশোরী মেয়ের দল বা ঝাল ঝাল ঘুগনি খেয়ে নাক লাল করে ঘুরে বেড়াবে।

একদম ছোট্ট ছোট্ট কুচোগুলো একটা বেলুন পেয়ে অথবা কাঠের ঘূর্ণিতে কাঠের হাতি ঘোড়ায় বসে কি খুশি! নব বিবাহিত কোনো যুবক হয়তো বাড়ির বড়দের চোখের আড়ালে কিনে নিচ্ছে একজোড়া ঝুটো মুক্তোর ঝুমকো কানের দুল কিংবা নকল সোনার পায়ের তোড়া যা দেখে তার নতুন অল্পবয়সী বৌ খুশিতে ঝলমল করে উঠবে। পরিবারের সবাই মিলে জিলিপি বা তেলেভাজা খাবেন আর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিনবেন গুড়ের কটকটি আর মালপুয়া। বাড়িতে যখন ফিরবেন সবার মুখে তখন সুখের, খুশির, আনন্দের, ভালবাসা মাখা হাসি।

ইচ্ছে করে না এরকম একটা মেলায় যেতে? চলুন তাহলে আজ আমাদের যাদু-জুতোতে পা গলিয়ে দিই আর হাতে হাতে তালি দিয়ে বলি "চলো পুরুলিয়া... খেলাই চণ্ডীর মেলায়"....

পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর থানার বেড়ো গ্ৰামের একটা পাহাড়ের নাম বেড়ো পাহাড়। এরই অপর নাম চণ্ডী পাহাড়। আর এই বেড়ো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত দেবী খেলাই চণ্ডীর মন্দিরের হয় এই মেলা। মাঘ মাসের প্রথম দিন দেবীর পুজো দিয়ে এই মেলা শুরু হয়। এই দিন বেড়ো এবং পাশাপাশি গ্ৰাম থেকে প্রচুর মানুষ আসেন এই মেলায়। মনস্কামনা পূর্ণ করতে এলাকার মানুষ পয়লা মাঘ দণ্ডি কেটে এসে মন্দিরের কাছের পুকুরে স্নান করে পুকুর থেকে থেকে দুহাতে মাটি তুলে নিয়ে উপরে ফেলে।

kheraichandi3

আসলে পুকুরে যাতে জল থাকে সবসময় সেইজন্যই হয়ত এই রীতি প্রচলিত হয়েছিল। চণ্ডী মন্দিরে পূজা দেওয়ার রেওয়াজ বহু প্রাচীন। ৫০০ বছরের পুরনো খেলাই চণ্ডী মেলা সম্প্রীতির মেলা হিসাবেই পরিচিত, আজও এখানে জড়ো হন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ ভক্ত মানুষ। পাঁচশো বছর আগে কাশিপুরের রাজার কূলগুরু শ্রী জগন্নাথ গোস্বামী বেড়ো পাহাড়ের নীচে খেলাই চণ্ডীর পুজো শুরু করেছিলেন এবং মেলাও তখন থেকেই শুরু হয়েছিল।

অনেক দূরে দূরে হাটবাজার থাকার কারণে আগে এই মেলায় কৃষকরা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন লাঙল, কোদাল, শস্যবীজ ইত্যাদি কিনে নিয়ে যেতেন। এখন গৃহস্থালীর মোটামুটি সব জিনিসপত্রই এই মেলায় বিক্রিবাটা হয়।

ভাল লাগল বেড়ো পাহাড়ের কোলের কাছে বসা এই মেলায় বেড়াতে এসে? এই বাংলার মায়াভরা গ্ৰামগুলিতে হতেই থাকবে এমন মেলা। আমরাও ঘুরে বেড়াব মনের পাখা মেলে দিয়ে আর গান গাইব "তাই খুশির সীমা নাই..."। কিছুক্ষণই নাহয় ভুলে থাকব অতিমারীর আতঙ্ক।

বাইরে বেরনোর সময় মাস্ক পরতে ভুলবেন না কিন্তু...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...