বাংলার মেলা: অগ্ৰদ্বীপের গোপিনাথ মেলা

হাওড়া-কাটোয়া লাইনে কাটোয়ার ঠিক তিনটি স্টেশন আগের স্টেশন হল অগ্রদ্বীপ। গঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা অগ্রবর্তী গ্রাম হিসেবে এই গ্ৰামের এমন নাম। বর্ধমান জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও জায়গাটি নদীয়া ঘেঁষা। গঙ্গা এখানে বিশেষ চওড়া নয়। খুব সহজেই নৌকায় এপার ওপার করা যায়। তো চলুন পাঠক বন্ধুরা, আজ আমরা যাব এই অগ্ৰদ্বীপে গোপিনাথের মেলায়।

এই অগ্ৰদ্বীপ অঞ্চলটি গোপীনাথ এবং বৈষ্ণব সাধক গোবিন্দ ঘোষের কারণেই বিখ্যাত। প্রত্যেক বছরই চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে এখানে মেলা বসে। এই অগ্ৰদ্বীপের মেলার প্রাণকেন্দ্রে রয়েছেন সাধক গোবিন্দ ঘোষ এবং তাঁর আরাধ্য গোপীনাথ।

Agradip1

কথিত আছে যে ইংরেজি ১৫১৫ সালের ফাল্গুন মাসে অগ্রদ্বীপে ভক্ত গোবিন্দ ঘোষের কাছে এসে ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। এই অগ্ৰদ্বীপে তিনি একটি কৃষ্ণের বিগ্রহ তৈরি করিয়ে প্রতিষ্ঠা করে তাঁর নাম দেন গোপীনাথ। এই গোপীনাথের সেবার দায়িত্ব ভক্ত গোবিন্দ ঘোষের হাতে দিয়ে তিনি নীলাচলের পথে রওনা দেন। 

এই গোবিন্দ ঘোষ ছিলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের এক ট্র্যাজিক উপাসক। তিনি কিন্তু গৃহী ভক্ত ছিলেন, সন্ন্যাসী নন। অল্প বয়সেই তিনি স্ত্রী এবং একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে গোপিনাথকে সন্তানস্নেহে আঁকড়ে ধরেছিলেন। গোপিনাথকেই সন্তানের মতো যত্ন করতেন, সেবা করতেন।

Agradip2

কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে 'মৃত্যুর পর কে তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া করবে' - এই কথা ভেবে রাতদিন আকুল হয়ে কাঁদতেন। কথিত আছে ভক্তের কান্নায় বিচলিত হয়ে তখন স্বয়ং ভগবান গোপিনাথ গোবিন্দ ঘোষকে দেখা দিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনিই গোবিন্দ ঘোষের পুত্র হিসেবে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর শ্রাদ্ধাদি পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করবেন।

এই লোকগাথাকে কেন্দ্র করেই অগ্ৰদ্বীপে গোপিনাথের মেলার প্রচলন। প্রায় সাড়ে চারশো বছরের পুরনো এই মেলা। অগ্ৰদ্বীপে ভগবান গোপিনাথের দুটি মন্দির রয়েছে। একটি পুরনো মন্দির এবং আরেকটি নতুন মন্দির বা দোলমন্দির। দোল পূর্ণিমার পরে গোপিনাথ জিউকে নিয়ে আসা হয় পুরনো মন্দিরে। এই মন্দিরের পাশেই রয়েছে গোবিন্দ ঘোষের সমাধি মন্দির।

কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে গোবিন্দ ঘোষ প্রয়াত হয়েছিলেন। ঐ দিন "চিঁড়ে মহোৎসব"-এর মধ্য দিয়েই শুরু হয় গোপিনাথ মেলা। ঠিক যেমন হিন্দু ধর্মে পিতার মৃত্যুর পর পুত্রের কাছা পরিধান করেন তেমনই গোপিনাথকেও কাছা ধারণ করতে হয়। তখন তাঁকে গোবিন্দ ঘোষের পুত্র হিসেবে দেখা হয়। ওই দিন মন্দির থেকে গোপীনাথ বিগ্রহ নিয়ে আসা হয় গোবিন্দ ঘোষের সমাধি মন্দিরে।

Agradip3

স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হাত দিয়ে মানব পিতার উদ্দেশ্যে কুশ ও পিণ্ডদান করেন। দেবতাকে কাছা পরিয়ে তাঁর মানব-পিতার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের এমন বিরল নমুনা আর ভারতবর্ষের কোনোখানে দেখা যায় না। এই ঘটনা নিজের চোখে দেখতে হলে আসতেই হবে গ্রামবাংলার এই মেলা প্রাঙ্গণে। প্রচলিত নিয়ম মেনে আগত পুণ্যার্থীদের সঙ্গে অগ্ৰদ্বীপের মানুষও এ দিন অরন্ধন পালন করেন। দ্বিতীয় দিনে অন্ন মহোৎসব, তৃতীয় দিন গঙ্গা স্নান, চতুর্থ দিন স্থানীয় ভাবে পালিত গোপীনাথের দোলের মধ্য দিয়ে মেলা শেষ হয়।

গ্ৰামীণ এই মেলায় মূলতঃ গ্ৰামবাংলার মানুষজনই আসেন। প্রচুর বৈষ্ণব ভক্তরাও আসেন ভগবান গোপিনাথ জিউ এবং রাধারাণীকে দর্শনের উদ্দেশ্যে। মেলায় জমিয়ে কেনাকাটা করেন সবাই। কাটোয়ার বিখ্যাত মণ্ডা এবং কাঠের পুতুলের বিক্রি চলে রমরমিয়ে। সব মিলিয়ে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয় এই মেলায়। কারও কারও মতে সংখ্যাটা আরো বেশি। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন নতুন করে জনসমাগম বাড়ছে অগ্রদ্বীপের মেলায়। চারদিন পর মেলা ভাঙলে শুরু হয় পরের বছরের মেলার অপেক্ষা।

পাঠক বন্ধু, ভাল লাগল তো অগ্ৰদ্বীপের মেলায় বেড়িয়ে? আরো নতুন নতুন মেলায় আমরা যাব আগামী দিনে।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...