বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি ছিলেন চন্দ্রাবতী। মধ্যযুগের নারী কবি ছিলেন চন্দ্রাবতী। সেই সময় যে কয়েকজন বাংলাদেশের শিক্ষিকা নারী সমাজের নির্দিষ্ট করে দেওয়া গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে নিজের পরিচয় গড়ে তুলেছিলেন চন্দ্রাবতী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি।
তিনি সপ্তদশ শতকের লোককবি। ষোড়শ শতকের মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদাস আর সুলোচনা দেবীর কোল আলো করে জন্মেছিলেন এই নারী কবি। ঠিক যেন চাঁদের আলো। তাই তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল চন্দ্রাবতী। তাঁর জন্মস্থান ছিল কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারি গ্রাম। কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে লোকসাহিত্যে বা লোক মানুষের কবি চন্দ্রাবতী এক উজ্জ্বল নক্ষত্র রূপেই পরিচিত।
চন্দ্রাবতী যে সময় জন্ম নেন সেই সময় মেয়েদের পড়াশোনা বা শিক্ষার চর্চা বিশেষ করে শিল্পের চর্চা মোটেই সহজ ছিল না। মেয়েরা কবিতা বা কাব্য চর্চা করবে সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনার বাইরেই ছিল। সেই যুগে নিজের প্রতিভা আর সৃজনশীল ক্ষমতার মাধ্যমে চন্দ্রাবতী রচনা করে গিয়েছিলেন চমৎকার লোকগীতিকা, পালাকাব্য গান ও রামায়ণ কাহিনী।
চন্দ্রাবতীর সৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে তাঁর ভালোবাসার ও দুঃখের কথা। কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের মানুষের স্মৃতিতে আজও চন্দ্রাবতীর করুণ কাহিনী পরিচিত। ময়মনসিংহ গীতিকায় অন্তর্ভুক্ত চন্দ্রাবতী পালাটি সেই নিয়েই রচিত। চন্দ্রাবতীর মৃত্যুর পর এই পালা রচনা করেছিলেন নয়নচাঁদ ঘোষ।
এই পালা অনুযায়ী চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দ ছোট থেকেই একসঙ্গে বড় হন। বড় হয়ে তারা একে অপরের প্রেমের সূত্রে আবদ্ধ হন। অভিভাবকদের সম্মতিতে যেদিন তাদের বিবাহের দিন স্থির করা হয় সেদিন এক অদ্ভুত ঘটনা চন্দ্রাবতীর জীবন ওলটপালট করে দেয়। জানা যায় অন্য একটি মেয়ের প্রতি নাকি আসক্ত চন্দ্রাবতীর হবু স্বামী জয়ানন্দ। মেয়েটির নাম আসমানী। শোনা যায় পরবর্তীকালে এই আসমানীকে বিয়ে করে জয়ানন্দ জয় টনাল নাম নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই ঘটনার আকস্মিকতায় চন্দ্রাবতী আঘাত পান। বিয়ে ভেঙে যায় চন্দ্রাবতীর।তবে এরপর আর কোনদিন কাউকে ভালবাসেননি চন্দ্রাবতী। জীবনটা একা কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাবা তখন মেয়ের পাশে দাঁড়ান। শিব পূজা ও রামায়ণ রচনার পরামর্শ দেন বাবা।
চন্দ্রাবতী তখন নিজেকে সৃষ্টিতে মগ্ন করে রাখেন। এদিকে জয়ানন্দের পরবর্তীকালে অনুশোচনা হয়। তিনি চন্দ্রাবতীর কাছে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। ক্ষমা চাইতে এসেছিলেন চন্দ্রাবতীর কাছে।কিন্তু অভিমানিনী চন্দ্রাবতী জয়ানন্দের সঙ্গে দেখা করেন নি। পরে অনুশোচনা দগ্ধ জয়ানন্দ স্থানীয় নদী ফুলেশ্বরীতে আত্মহত্যা করেছিলেন। পরবর্তীকালে লোকসাহিত্য গবেষক ও লেখক দীনেশচন্দ্র সেন ও ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত যথাক্রমে ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকায় চন্দ্রাবতী পালাটির পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবরণ রয়েছে।
এই চন্দ্রাবতী মলুয়া দস্যু, কেনারামের পালা ও রামায়ণ পালাও রচনা করেছিলেন। সেই সময়কার বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসমাজ ও সংস্কৃতির চিত্র মুন্সিয়ানার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছিলেন চন্দ্রাবতী। মধ্যযুগের যে সময়ে চন্দ্রাবতীর রচিত কাব্য-সাহিত্যে অন্যতম জায়গা করে নিচ্ছিল সাধারণত সেই সময় দেব-দেবী নির্ভর সাহিত্য রচনার প্রচলন ছিল। চন্দ্রাবতী ছিলেন অন্যরকম। তিনি সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, প্রতিবাদ, আর বীরত্বের জয় গান গেয়েছেন তাঁর দুটি গীতিকা পালায়।
চন্দ্রাবতী তাঁর জীবনের পরিণত সময়ে রচনা করেছিলেন রামায়ণ পালাটি যেখানে তিনি বাল্মিকী রামায়ণ কাহিনীকে অনুসরণ করেন নি, বরং এই বিষয়ে প্রচলিত গ্রাম্য গল্পকে প্রাধান্য দিয়ে এক অন্যরকম রামায়ণ পালা রচনা করেছিলেন। তিনি শৃঙ্গার রস, ভক্তি রস, বা বীর রসকে প্রাধান্য দেননি রামায়ণ রচনার ক্ষেত্রে। তিনি প্রচলিত রামায়ণকারদের পথে না হেঁটে সীতার জীবনকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন রামায়ণ রচনার ক্ষেত্রে।রামায়ণের একটি অংশে তিনি কথক হিসেবে সীতাকেই রেখেছিলেন। সীতা তাঁর নিজের দুঃখের কথা বর্ণনা করেছেন চন্দ্রাবতী রচিত রামায়ণে। বাংলার লোকসাহিত্যে চন্দ্রাবতীর রচনা অন্যতম। জীবনের কথা বলায় চন্দ্রাবতীর রচিত গীতিকার জুড়ি মেলা ভার। মধ্যযুগীয় কবিদের কথা আলোচনা করলে চন্দ্রাবতীর নাম সবার আগে আসে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।