একসময় বাড়ির ‘রাঁধিয়ে ঠাকুর’ মানেই তিনি ওড়িশার মানুষ-এই ছিল আম বাঙালির চেনা ধারনা। বাড়ির হেঁশেল তো বটেই পাইস হোটেল থেকে নামকরা ভাতের হোটেল সর্বত্র ছিল ওড়িশার রন্ধনশিল্পী কদর। আজও সেই ধারণা ফিকে হয়ে যায়নি। বিশুদ্ধ বাঙালি খাবারে তাঁরা জয় করতেন রসিক মন। কুমড়োর ছেঁচকি হোক না মোচার ঘন্ট, পাবদা, চিংড়ি ইলিশের আমিষ পদেই তাঁদেরই হাত যশ!
কিন্তু একমন হয় আসল ওড়িশি খাবারের স্বাদ? ঝটপট উত্তর চাইলে মুশকিলে পড়বেন অতি বড় ভোজনরসিকতিক। চেনা কয়েকটা মিষ্টির নাম আর ডালমা ছাড়া বাকিটা ভাবতে হবে।
সমুদ্রের তীর, প্রভু জগন্নাথের মন্দির, মুচমুচে খাজা, পিপলি শিল্পের নজরকাড়া সম্ভার, ওড়িশি নৃত্যকলা, মন্দির গাত্রের অপূর্ব শিল্প এই সবই মানুষের কাছে পড়শী রাজ্য ওড়িশার ‘সিগনেচার’। কিন্তু ওড়িশার খাবারের লিস্টের বৈচিত্র্যও কম নয়। মেইনকোর্স থেকে সাইড ডিশ তো বটেই- স্ট্রিট ফুডেও গোল দিতে পারে যে কোনও রাজ্যকে। জগন্নাথ ভূমিকে অন্যভাবে চেনা যায় সেখানকার খাবার দিয়ে। এই নিবন্ধে রইল ওড়িশার বিখ্যাত স্ট্রিট ফুডের সন্ধান।
দহি বড়া আলুর দম- দই বড়া আর আলুর দম মিলতে পারে কখনও? কিন্তু এই দুই পদকে মিলিয়ে একপদে পরিণত করার দুরন্ত কৃতিত্ব দেখিয়েছেন ওড়িশাবাসী। ‘দহি বড়া আলুর দম’ ওড়িশার সবচেয়ে জনপ্রিয় স্ট্রিটফুড।
বড়া ঘুগনি- ওড়িশার আর এক বিখ্যাত পথ-খাবার বড়া ঘুগনি। মটর কড়াইকে সেদ্ধ করে পিষে তাতে বিভিন্ন ধরনের মশলা মেশানো হয়। তারপর ডিপ ফ্রাই করা বড়ার সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। সঙ্গে থাকে পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা আর ধনেপাতা।
মুড়ি মাংস- মুড়ি দিয়ে মাংস খেয়েছেন? ওড়িশার রাস্তায় জনপ্রিয় এক পদ মুড়ি মাংস। রান্না করা মশলাদার আলু আর খাসির মাংসের কিমা এক সঙ্গে মিশিয়ে পরিবেশন করা হয় মুড়ির সঙ্গে। সঙ্গে থাকে নানা রকম ঝাল চাটনি আর আচার। এমন ‘ফাস্ট ফুড’ গোটা দেশে আর কোথাও পাবেন না বলাই যায়!
ছানা পোড়া- ওড়িশা যাবেন আর ছানাপোড়া খাবেন না তা কখনও হয়! ছানাকে চিনি বা গুড় দিয়ে ডিপ ফ্রাই করা হয়। অনেক সময় বাদাম, কিশমিশও থাকে। দুভাবেই সমান জনপ্রিয় ছানাপোড়া। ছানাপোড়ার উৎপত্তি বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, ওড়িশার দাসপাল্লা গ্রামে। মিষ্টান্ন প্রস্তুত সুদর্শন সাহু এক রাতে বেঁচে যাওয়া ছানায় চিনি এবং মশলা যোগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং উনুনে রেখে দেন। উনুনটি আগে ব্যবহার করা হয়েছিল। তাত তখনও পড়েনি। পরের দিন দেখেন ছানা পুড়ে যে বস্তুটি তৈরি হয়েছে তা যথেষ্ট লোভনীয়। ২০২২ সাল থেকে ১১ এপ্রিল দিনটি পালিত হয় ছানাপোড়া দিবস। দিনটি সুদর্শন সাহুর জন্মবার্ষিকী।
খাজা- ওড়িশার সিগনেচার খাজা। পুরীর খাজার বিশ্বজোড়া খ্যাতি। জগন্নাথ দেবের প্রিয় ঘিয়ে ভাজা খাজা। ওড়িশায় নানা ধরনের খাজা পাওয়া যায়। তাদের আকার ভেদে স্বাদও হয় ভিন্ন।
খাজা পুরীতে এল কী করে?
খাদ্য সংস্কৃতির আদানপ্রদান তো বটেই, কিন্তু এর সাথে আছে দৈব মাহাত্ম্যের সংযোগ। কথিত আছে, এক মুসলমান হালুইকারের শখ হয় যে তিনি জগন্নাথ দেবকে তার বানানো খাজা নিবেদন করবেন। কিন্তু ধর্মীয় বৈষ্যম্যের কারণে সে তো অসম্ভব। কিন্তু স্বয়ং জগন্নাথ স্বামী তাকে এক্কেবারে আলাদাভাবে খাজা বানানোর স্বপ্নাদেশ দেন এবং সন্ধ্যের ঠিক আগে তা মন্দিরে নিয়ে যেতে বলেন। হালুইকার প্রভুর কথামতো সেই খাজা বানিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে গেলে রক্ষী আর পুরোহিতদের সাথে বিস্তর গোল বাধে। ইতিমধ্যেই প্রায় সন্ধ্যার মুখে হঠাৎই এক কালো কুকুর ঝাঁপিয়ে একটা খাজা মুখে নিয়ে দৌড়ে মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করে, বিতন্ডা থামিয়ে সবাই তাকে ধাওয়া করলেও তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সেই খাজা অর্ধভুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় জগন্নাথ স্বামীর সম্মুখে। তখনই গর্ভগৃহ থেকে প্রভুর দৈববাণী শোনা যায়, তিনি বলেন যে, তাঁর এই খাজা খাওয়ার ইচ্ছে হয়, কিন্তু সেই ইচ্ছে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় সে নিজেই কুকুর রূপ ধারণ করে তা গ্রহণ করলেন, সাথে নির্দেশ দিলেন এরপর থেকে যেন প্রতি সন্ধ্যেবেলা এই খাজা তাকে ভোগ দেওয়া হয়, তবে এই ভোগ তিনি নিবেদনের আগে নিজেই গ্রহণ করে নেবেন। সেই শুরু খাজা অর্থাৎ ফেনীর যাত্রা; আজও সন্ধ্যেবেলায় বড়শৃঙ্গার ধুপভোগে অর্থাৎ সন্ধ্যে ৬টার ভোগে নিবেদন করা হয় এই ফেনী।
রসাবলী- বলদেবজেউকে রসাবলী নিবেদন করা হয় এবং এর উৎপত্তি কেন্দ্রপাড়ার বলদেবজিউ মন্দিরে, এটি জগন্নাথ মন্দিরের ছাপ্পান্ন ভোগের একটি। উৎপত্তি এখানকার ৪০০ বছরের পুরানো বলদেবজেউ মন্দির থেকে। ওড়িশার কেন্দাপাড়া জেলার বলদেবদেব মন্দিরে গত কয়েক শতাব্দী ধরে প্রতিদিন এই মিষ্টি অর্পণ করা হচ্ছে। তাছাড়া, এটি বিশেষত উৎসব উদযাপন উপলক্ষে ওড়িয়া বাড়িতে পরিবেশন করা হয়। ভগবান বলদেবদেবকে 'ভোগ' হিসাবে 'রসাবলী' দেওয়ার প্রথা মহারাজা অনং ভীম দেবের সময়ে শুরু হয়েছিল এবং এই প্রথা এখনও অব্যাহত রয়েছে। কেন্দাপাড়া অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ এই সুস্বাদু খাবার বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন