বাংলার অপরিসীম শিল্পের ভাণ্ডারের এক উজ্জ্বল অংশ হল পটচিত্র, যা বহুকাল আগে থেকেই বাংলার শিল্পকে ঐতিহ্যমন্ডিত করে রেখেছিল এবং রেখে চলেছে বছর বছর ধরে। এই পটচিত্রের দক্ষতা বংশপরম্পরায় আপন করে নেয় শিল্পীরা। পটচিত্রের বিবর্তনের ইতিহাসটা একটু অন্যরকম। প্রাচীনকালে পট ছিল যোগাযোগের মাধ্যম। পটশিল্পীরা ছিলেন একাধারে লেখক, চিত্রকর ও গায়ক। পট তাদের কাছে কোন বিক্রয়যোগ্য পণ্য ছিল না। বিভিন্ন হিন্দু আখ্যান কাহিনী, লোকাচার ইত্যাদিকে ছড়ার আকারে লিপিবদ্ধ করে তৈরী হত গান ও তাকেই তুলির টানে জড়ানো পটে চিত্রায়িত করা হত। এভাবে অডিও ও ভিডিও এই দুটো রুপেই মেসেজ বা বক্তব্য উপস্থাপিত করা হত জনসাধারণের কাছে। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে পটের পরিবর্তন হয় দুভাবে, প্রথমত নানাবিধ যোগাযোগ মাধ্যম আসে যা পটের প্রচলিত চাহিদা কমিয়ে দেয়, দ্বিতীয়ত যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে পটের চাহিদা কমলেও পটশিল্পকলার চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়, পট হয়ে ওঠে বিক্রয়যোগ্য পণ্য। আর নতুন আবির্ভাবপ্রাপ্ত যোগাযোগ মাধ্যমগুলি এই শিল্পেরই প্রচার ও বিস্তার ঘটায় বাংলা-ভারত-বিশ্বের দরবারে।
পূর্বপুরুষদের থেকে পাওয়া প্রশিক্ষণে ধরাবাঁধা কিছু ধারা, রঙ, রেখা, ভাবের সাদৃশ্য থাকেই। এক এক অঞ্চলে পটের শিল্পশৈলী এক এক রকম। তবে গ্রামাঞ্চলের পটশিল্পীরা যখন জীবিকার তাগিদে শহর কলকাতায় আসতে শুরু করে তাদের শিল্পশৈলীতে লাগতে থাকে শহুরে ছোঁয়া। শহরের বাবু কালচার ও তাদের বিলাসবহুল জীবন এসব হয়ে উঠতে থাকে পটের বিষয়বস্তু। বীরভুম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর এগুলো ছিল পটচিত্রের কেন্দ্র। এর মধ্যে মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম জগদ্বিখ্যাত। সময়ে-অসময়ে বছরের বিভিন্ন সময়েই বহু বিদেশী আসেন নয়ায়। এখানকার পটশিল্পীদের কাজ শুধু ভারতেই নয় সমগ্র পৃথিবীতে জায়গা করে নিয়েছে। এদের আগের প্রজন্মের অনেকেই কলকাতায় চলে এসেছিলেন এবং বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন পটশিল্পীর শিল্পের মিশ্রণে গড়ে উঠেছিল কালীঘাট পটচিত্র।
নয়া ও কালীঘাটের পটচিত্রের মধ্যে রয়েছে বিস্তর মিল ও অমিল। নয়ার পটচিত্রের বিষয়বস্তুর পরিধি যথেষ্ট বিস্তৃত, পৌরাণিক থেকে শুরু করে সামাজিক, আর্থ-সামাজিক, ঐতিহাসিক, সমসাময়িক ইত্যাদি বিষয়েও পট তৈরী করেন শিল্পীরা। তাঁদের তুলির টানে যেমন জীবন্ত হয়ে ওঠে পুরাণের বেহুলা-লক্ষীনদর, রাম-লক্ষণ-সীতা, চৈতন্য, শিব-পার্বতীর মত চরিত্র, তেমনি বর্তমানও সমানভাবে উজ্জ্বল যেমন – কন্যাশ্রী, নির্ভয়াকান্ড ইত্যাদি। শিল্পীরা এর জন্য জড়ানো পট, চৌকো পট এই দু ধরনের পটই ব্যবহার করে থাকেন, তার মাপও হয় বিভিন্ন। অপরদিকে কালীঘাটের পটচিত্রের বিষয়বস্তুতে প্রথম থেকেই দেব-দেবীর প্রাধান্য দেখা গেছে, এখানকার পটচিত্রে সরাপট, বাঙালির অন্দরমহলে জায়গা করে নিয়েছিল। পরে বাবু-সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যায়। আগেকার দিনে বাবুদের জীবনযাপন, পোষাক-আশাক, অভ্যাস এসব নিয়েই কালীঘাটের পট মূলত তৈরী হয়েছে। গোলাপসুন্দরী, এলোকেশী মাহান্ত, চড়ুই ইত্যাদি হল কালীঘাটের পটচিত্রের মধ্যে অন্যতম।
নয়ায় পটশিল্পীরা রঙ হিসাবে ব্যবহার করেন প্রাকৃতিক রঙ, পাতা-ফুল-ফলের নির্যাসই হল তার উৎস। সবুজ রঙের জন্য সিম পাতা বা হিংচে শাকের রস, কালো রঙের জন্য ভুসোকালি, সাদা রঙের জন্য খড়িমাটি, বেগুনী রঙের জন্য জাম ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। কালীঘাটের রঙের ব্যবহার নয়ার থেকে একেবারেই আলাদা। এখানে রাসায়নিক রঙ ব্যবহার করেই পট আঁকা হয়। তুলি ও কাগজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, নয়া এবং কালীঘাট দু জায়গাতেই বাজার থেকে তুলি-কাগজ কিনেই আঁকা হয়।
নয়া ও কালীঘাটের পটচিত্রের তুলির টানের মধ্যে রয়েছে নানান বৈসাদৃশ্য। নয়াতে যে সমস্ত পটচিত্র আঁকা হয় তাতে মূলত ওয়ান স্ট্রোক পদ্ধতিতে রঙ করার প্রচলন আছে। কালীঘাটে যে সমস্ত পটচিত্র আঁকা হয় তাতে মূলত শ্যাডো বা আলোছায়া প্রভাব রেখে রঙ করার প্রচলন আছে।
কালীঘাটের পট মূলত চৌকো পট, নয়াতে জড়ানো ও চৌকো দুধরণের পটই নিয়ে কাজ হয় অর্থাৎ দুয়ের প্রাধান্য সমান।
নয়ার পট তৈরীর পদ্ধতি কালীঘাটের থেকে ভিন্ন। নয়াতে পট তৈরীর প্রথম ধাপ হল একের পর এক কাগজ জুড়ে তার দৈর্ঘ্যবৃদ্ধি করা। যে কাহিনী নিয়ে পটটি তৈরী হবে তার গান রচনা করেন শিল্পী। গান অনুযায়ী প্রতিটি চরিত্রকে ক্রমানুসারে সাজানো। এরপর প্রয়োজনমত পেন্সিল-স্কেচ করা হয় এবং তাতে রঙ করা হয়। এভাবেই পুরো কাহিনী বর্ণনা করা হয়। কালীঘাটের পটের ক্ষেত্রে এই কাহিনীর বর্ণনা অতটা পরিলক্ষিত হয় না। মূলত চৌকো পটের মাধ্যমেই কোন এক নির্দিষ্ট ঘটনা বা চরিত্র বর্ণিত হয়। নয়াতে পটের কাহিনীকে গানের মাধ্যমে বুঝিয়ে উপস্থাপন করা হয়, কিন্তু কালীঘাটে এইভাবে গানের মাধ্যমে উপস্থাপনা করা হয় না।
ব্যবসায়িক আঙ্গিকের কথা বলতে গেলে নয়াতে ব্যবসার জন্য পট তৈরীর প্রচলনের মূলে কোন ব্যবসায়িক লাভ জড়িত ছিল না। তবে কালীঘাটে পটশিল্পের প্রচলনই হয় বিক্রয়ের কথা মাথায় রেখে। তাই এখানে খুব দীর্ঘ জড়ানো পট তৈরী কম ও চৌকো পট তৈরী বেশী হত।
মূলত মেদিনীপুরের পটশিল্পীরাই পরবর্তীকালে শহরে চলে আসেন এবং তাঁরাই কালীঘাটে পটশিল্পের প্রবর্তন করেন। তাই কালীঘাটের পটুয়া আর নয়ার পটুয়াদের মধ্যে তফাত নেই, আছে শিল্পের তফাত। আর এভাবেই ফুটে ওঠে একই শিল্পের দুটি রূপ।