পল্লীবাংলার চণ্ডী পুজোর ইতিহাস ও বিবর্তন

বাংলায় অগুনতি লৌকিক দেব, দেবীর পুজোর প্রচলন রয়েছে। লৌকিক দেবীদের মধ্যে বিশেষ স্থান পান চণ্ডী, যেমন, ওলাই চণ্ডী, মঙ্গল চণ্ডী, উরণচণ্ডী, উদ্ধার চণ্ডী, নাটাই চণ্ডী, অলকা চণ্ডী এমনকি, হাড়ি ঝি চণ্ডী অবধি আছেন। এখন অবধি প্রায় ১০৩ রকমের চণ্ডীর খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। কোথাও তিনি গ্রামদেবী, কোথাও আবার কুলদেবী, আবার কোথাও গৃহদেবী রূপে তিনি পূজিত হন।

সাধারণত নানা রকম প্রতীকে চণ্ডী পুজো হয়। যেমন খোদিত শিলা মূর্তি, খোদিত নয় এমন শিলা খণ্ড, মাটির ঢেলা, লাল ঘোড়া, বৃক্ষ পুজো, মাটির মূর্তি, ধাতু মূর্তি ইত্যাদি।

ওলাইচণ্ডী:

তেমনই একজন চণ্ডী দেবী হলেন দেবী ওলাইচণ্ডী। রোগব্যাধী থেকে মুক্তি পেতে বাংলায় একাধিক দেবদেবীর পুজোর প্রচলন হয়েছিল। মুসলমান প্রধান অঞ্চলে তিনিই ওলাবিবি নামে পরিচিত।

বিসূচিকা অর্থাৎ কলেরা রোগের অপর নাম হল ওলাওঠা। কলেরা রোগের প্রধান লক্ষণ হল বারেবারে বমি এবং ঘন ঘন মল ত্যাগ হওয়া, যার ফলে শরীর জল ও লবণ শূন্য হয়ে পড়ে এবং রোগী মারা পর্যন্ত যেতে পারেন।

প্রচলিত গ্রাম্য শব্দ ওলা অর্থাৎ নামা এখানে মল ত্যাগের কথা বলা হয়েছে এবং উঠা বা ওঠা অর্থাৎ উঠে আসা, বমি হওয়া। এই দুই মিলেই ওলাওঠা শব্দের জন্ম। আজ কলেরায় রোগ নিরাময় সম্ভব। কিন্তু এককালে কলেরা ছিল মারাত্মক। গ্রামের পর গ্রাম উজার হয়ে যেত। ভয় থেকেই আমাদের ভক্তি ও ভগবানের উদয়। কলেরা থেকে রক্ষা পেতেই মানুষ দেবী ওলাইচণ্ডীর পুজো দিতে আরম্ভ করল।

ঐতিহাসিকদের মতে, ওলাইচণ্ডী দেবীর আদি নাম হল ওলাউঠা-চণ্ডী বা ওলাউঠা-বিবি। একই দেবী হিন্দুদের কাছে ওলাইচণ্ডী ও মুসলমানদের কাছে ওলাবিবি নামে পরিচিত।

প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে মনে করা হয়, ওলাওঠা রোগের দেবী ওলাইচণ্ডী হলেন ময়াসুরের পত্নী। হিন্দু পুরাণ অনুসারে এই ময়াসুর হল অসুর, দানব, রাক্ষস ও  দৈত্যদের রাজা ও স্থপতি।

ওলাইচণ্ডী দেবী এককভাবে পূজিত হন। এছাড়াও কোনও কোনও থানে সাতবোন বা নয়বোন নিয়ে ওলাবিবির পুজোর প্রচলিন রয়েছে। এই সাত বোনের নাম হল ওলাবিবি, ঝোলাবিবি, আজগাইবিবি, চাঁদবিবি, বাহড়বিবি, ঝেটুনেবিবি ও আসানবিবি।গবেষকদের একাংশের মতে লৌকিক "সাতবিবি" হিন্দু সপ্তমাতৃকা তত্ত্ব অর্থাৎ ব্রহ্মাণী বা ব্রাহ্মী, বৈষ্ণবী, মাহেশ্বরী, ইন্দ্রাণী বা ঐন্দ্রী, কৌমারী, বারাহীচামুণ্ডা-এর দ্বারা প্রভাবিত। তবে সপ্তমাতৃকার সঙ্গে সাতবিবির কোনও সাদৃশ্য নেই বললেই চলে। প্রাচীন কাল থেকেই ভারতে সাত দেবীর পুজো প্রচলিত ছিল, মহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে প্রাপ্ত একটি সিলমোহরে যার প্রমান মিলেছে।

প্রধানত দুই প্রকারের ওলাইচণ্ডী বা ওলাবিবির মূর্তি দেখা যায়। হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মতোই অনুরূপ রূপে বিরাজমান দেবী। তাঁর গায়ের রং হলুদ, সবুজ, মুখ সুন্দর, দ্বিনয়না বা ক্ষেত্রবিশেষে ত্রিনয়না, এলোকেশী অথবা মুকুট-পরিহিতা, বিভিন্ন অলংকারে সুসজ্জিতা, পরনে থাকে শাড়ি এবং দেবী দণ্ডায়মান মুদ্রায় বিরাজ করেন। কোথাও কোথাও দেবী ষষ্ঠীর মতো দেবী ওলাইচণ্ডীর কোলে শিশুসহ উপবিষ্ট দেবীমূর্তিও দেখা যায়। কোনও কোনও স্থানে দেবীর বাহন হিসেবে ঘোড়া দেখা যায়।
মুসলমান প্রধান অঞ্চলে দেবী পিরান ও পাজামা, মাথায় টুপি ও পায়ে নাগরা জুতো পরিহিতা। সেক্ষেত্রেও দেবীকে বিভিন্ন অলংকারে সজ্জিতা রূপেই দেখা যায় এবং তাঁর হাতে থাকে আসাদণ্ড।

হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে শনি-মঙ্গলবারেই ওলাইচণ্ডীর বিশেষ পুজো হয়ে থাকে। মুসলমান প্রধান অঞ্চলে শুক্রবারে ওলাবিবির পুজো করা হয়। ওলাইচণ্ডীর পুজোর বিশেষ কোনও মন্ত্রও নেই। মহিলারাও দেবীর পুজো করতে পারেন। বাগদি,ডোম প্রভৃতি তথাকথিত নিম্নবর্ণীয় হিন্দুরাও দেবীর পুজোয় পৌরোহিত্যের অধিকারী। কোন বিশেষ আচারও নেই তবে শনি-মঙ্গলবারে দেবীকে নিরামিষ ভোগ দেওয়ার রীতি রয়েছে। কোথাও কোথাও দেবীর পুজোয় ছাগবলি দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। নদিয়ার ডোম নারীরা পশুবলি দিয়ে ওলাইচণ্ডীর পুজো করেন। সন্দেশ, পান-সুপারি, বাতাসা, আতপ চাল, পাটালি ইত্যাদি শুকনো নৈবেদ্যে পুজো হয়। তবে ক্ষেত্র বিশেষে ওলাইচণ্ডীর পুজোয় অন্নভোগ প্রদানের রীতি রয়েছে।

ওলাবিবি যেখানে সাতবোনের সঙ্গে অবস্থান করেন, সেই মন্দিরগুলিকে বলা হয় সাতবিবির থান। এই থানগুলিতে পৌরোহিত্য করেন মুসলমান ফকিরেরা। সাত বনদেবীর পুজোর সঙ্গে সাতবিবির পুজোর মিল পরিলক্ষিত হয়। এই সাত দেবী বা সাত বোনের মধ্যে ওলাইচণ্ডী বা ওলাবিবিই প্রধান। সাত বিবিদের নিয়ে মধ্যযুগে বেশ কিছু গান রচিত হয়েছিল, যেগুলি সাতবিবির গান নামে পরিচিত। এই বিবির গানে রয়েছে ওলাবিবির আখ্যান। এই আখ্যান অনুসারে, তিনি এক কুমারী মুসলমান রাজকন্যার সন্তান। তিনি অলৌকিক উপায়ে অদৃশ্য হয়ে যান এবং পরে দেবী রূপে আবির্ভূত হন। তাঁর আবির্ভাবের কারণ ছিল তাঁর দাদামশাইয়ের ও রাজ্যের মন্ত্রীদের সন্তানদের আরোগ্য দান।

এখান থেকে ভক্তেরা তাঁকে অরোগ্য দানের দেবী, অর্থাৎ কলেরার হাত থেকে ত্রাণকর্ত্রী দেবী মনে করে পুজো করতে শুরু করেন। রোগ ও মহামারীতে আক্রান্ত অঞ্চলে দেবীর হয়।

বর্তমানে কলেরা প্রসঙ্গ না থেকে প্রথাগত ও পারম্পরিকভাবে পাড়া পল্লীতে শনিবার বা মঙ্গলবা পুজোর আয়োজন করা হয়। পুজোর রীতির মধ্যে রয়েছে, মাঙ্গন নেওয়া। পল্লীর প্রধান গলায় বদির মালা অর্থাৎ খড়ের হার পরে দাঁতে তৃণধারণ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুজোর জন্যে অর্ঘ্য হিসেবে অর্থ-চাল-ডাল-ফলমূল মধুকরী করেন। পুজোর দ্বিতীয় অংশ হল ছলন-সলন অর্থাৎ দেবীর ক্ষুদ্রাকৃতি মূর্তি বানিয়ে পুজোস্থানে রেখে দেওয়া হয়।

সম্ভব দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা থেকেই ওলাইচণ্ডী বা ওলাবিবির উৎপত্তি। পরবর্তীতে কলকাতা, উত্তর চব্বিশ পরগনা, হাওড়া,  পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম ও নদিয়া ইত্যাদি জেলায় পুজোর প্রচলন শুরু হয়। গাছতলা, বনাঞ্চল ও জলাশয়ের ধারে অবস্থিত থানে দেবীর পুজো প্রচলিত থাকলেও, পরবর্তীকালে বাংলা জুড়ে নানান জায়গায় ওলাইচণ্ডীর মন্দির নির্মাণ শুরু হয়। কলকাতা ও হাওড়ায় ওলাইচণ্ডী বা ওলাবিবিরর বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে।

এদের মধ্যে কিছু রয়েছে অন্য কোনও দেবতা মন্দির, যেখানে অন্য দেবতার সঙ্গে ওলাইচণ্ডী পূজিত হন। আবার কোনওটি ওলাইচণ্ডীরই মন্দির, যেখানে অন্য দেবতারাও পুজো পান। হাওড়া শহরে ওলাইচণ্ডী লেন নামে একটি রাস্তা রয়েছে। কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রোডে শীতলা মন্দিরে, বাঞ্চারাম অক্রূর লেনের বাঁকারায় ধর্মঠাকুর মন্দিরে ও বেলগাছিয়া রোডের ওলাইচণ্ডী মন্দিরে অন্যান্য দেবদেবীদের সঙ্গে ওলাইচণ্ডীও পূজিতা হন। গড়িয়ার বৈষ্ণবঘাটায় ওলাবিবির একটি মন্দির রয়েছে।

স্থানীয় হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অধিবাসীরাই মন্দিরটি পরিচালনা করেন। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগরে, রক্তাখাঁ পাড়া গ্রামে ওলাবিবির একটি মন্দিরে দেবী বিবিমা নামে পুজো পান। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতায় রাজকোট দুর্গে অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে ওলাইচণ্ডীরও পুজো হয়। বীরভূমে বোলপুর নীলকুঠির পাশেও ওলাইচণ্ডীর একটি মন্দির রয়েছে।

উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়ায় ওলাইচণ্ডী মন্দিরে ষষ্ঠী, শীতলা ও মনসার সঙ্গে ওলাইচণ্ডীর পুজো করা হয়। শোনা যায়, তার আগে ঐস্থানে একটি পঞ্চানন মন্দির ছিল। জনশ্রুতি রয়েছে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির জনৈক কুঠিয়ালের স্ত্রী ডনকিং কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে ওলাইচণ্ডী দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তাঁর স্বামী ডনকিং এক মুসলমান আর্দালিকে সঙ্গে নিয়ে সেই পঞ্চানন মন্দিরে এসে পূজারিণী ব্রহ্মময়ী দেবীকে স্বপ্নের কথা জানালে, ব্রহ্মময়ী দেবীই নিকটবর্তী একটি ঝিল থেকে ওলাইচণ্ডীর শিলামূর্তি মাথায় করে নিয়ে এসে ১১৭৬ বঙ্গাব্দে এই মন্দিরে ওলাইচণ্ডীর শিলামূর্তি স্থাপন করেন।

বর্তমানে এই মন্দিরে একটি উঁচু বেদিতে মনসা, শীতলা, ষষ্ঠী ও ওলাইচণ্ডীর পিতলের মূর্তি স্থাপ করা হয়েছে। মূর্তিগুলির উচ্চতা ২ ফুট। প্রতিদিন চণ্ডীর ধ্যান ও মন্ত্রে নিত্য পুজো চলে, সকালে ও সন্ধ্যায় দু-বার শুকনো ভোগ নিবেদন করা হয়। চৈত্রমাসে শীতলা পুজো ও অক্ষয়তৃতীয়ায়, এই মন্দিরে দুই বাৎসরিক উৎসব পালন করা হয়। এই সময়ে বহু ভক্তসমাগম হয় মন্দিরে। এই উৎসবেই শুধুমাত্র অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। পুজোয় বলিদানের প্রথা না থাকলেও মানতপূরণের বলি হয়ে থাকে। মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরাও এখানে মানত পূরণের বলি দিতে আসেন।

বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হল ওলাইচণ্ডী দেবী। যদিও কলেরার চিকিৎসা উন্নত হয়ে যাওয়ায় ওলাইচণ্ডী পুজোর পরিসর সীমিত হয়ে গিয়েছে কিন্তু তাও বাংলার নানান প্রান্তে দেবী পূজিত হন। ওলাইচণ্ডী দেবীর আরাধনায়, লোকাচার আর হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির মেলবন্ধন ঘটেছে।

আরও কয়েক লৌকিক চণ্ডী পুজোর ইতিকথা।

মুক্তাইচণ্ডী:

পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোলের ফুলবেরিয়া গ্রামে একটি পাহাড় রয়েছে, যার স্থানীয় নাম মুক্তাইচণ্ডী পাহাড়। নাতিউচ্চ পাহাড়েই মুক্তাইচণ্ডী মন্দির অবস্থিত। এই মন্দিরের মুক্তাইচণ্ডী শক্তিপীঠ নামে পরিচিত। যার নেপথ্যে রয়েছে, একটি জনশ্রুতি। সেই মতে সতীর মৃত্যুর পরে শিব যখন সতীর দেহ নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য করছেন। সেই সময়ে নাকি সতীর নাকছাবির মুক্তোটি এখানে ছিটকে পড়ে।

তাই এই জায়গাটির নাম হয়, মুক্তাইচণ্ডী শক্তিপীঠ। বেদ, উপনিষদ, পুরাণে কোথাও চণ্ডীদেবীর উল্লেখ নেই। তখনও বাঙালি জাতির উদ্ভব হয়নি। ঐ সময়ের প্রোটো অস্ট্রালয়েড সম্প্রদায়ের অন্যতম সম্প্রদায় ছিল ওরাওঁ, আজকের বাংলার কৃষক সম্প্রদায় এই ওরাওঁদের থেকেই বংশোদ্ভূত। সম্ভবত ওড়িশা থেকেই এরা এসেছিল। তখন এদের নাম ছিল উড্র। আজ তারা হিন্দু সমাজে মিশে গিয়েছেন। এখন এরা প্রায় সবাই গৃহস্থ চাষি।

তাদেরই শিকারের দেবী ছিলেন চাণ্ডী। শিকারের সময় এদের সঙ্গে থাকত চাণ্ডী শিলা। যখন বহিরাগত আর্যরা প্রাক-আর্য দেব, দেবীদের আর্যীকরণ শুরু করেন, তখনই মার্কণ্ডেয় পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের সৃষ্টি হয়। ঐতিহাসিদের মতে, ওরাওঁদের পূজিত এই চাণ্ডীদেবীই আমাদের লৌকিক সংস্কৃতিতে মিশে গিয়েছে চণ্ডীদেবী। উচ্চবর্ণের চণ্ডীর সঙ্গে লৌকিক চণ্ডীর পুজোর অমিলই বেশি। মুক্তাইচণ্ডী মন্দিরে দেবী শীতলা অবস্থান করেন। এখানকার চণ্ডী মূর্তিটি এবং দেবীর থানটি অত্যন্ত প্রাচীন, বহুকাল আগে, পাহাড় কেটে তার মধ্যে প্রাচীন শিলাটি স্থাপন করা হয়েছিল।

আদি শিলামূর্তিটি প্রায় দেড় ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট, তির ধনুক নিয়ে এক স্ত্রী যোদ্ধার মূর্তি। একদা মূর্তিটিতে ছয়টি ঘোড়া খোদিত ছিল, অর্থাৎ ছয় ঘোড়ায় দেবী আসীন ছিলেন। বর্তমানে মূর্তিটি মাঝখান থেকে ভেঙে গিয়েছে। ছটির মধ্যে এখন কেবল তিনটি ঘোড়া অবশিষ্ট। তবে বর্তমানে একটি আধুনিক পাথরের মূর্তি, শিলা মূর্তির পাদদেশে স্থাপিত করা হয়েছে, দেবী চণ্ডী নাম দিয়ে।

শোনা যায়, চাণ্ডী শিলার পুরোহিত ছিলেন ওরাওঁদের পুরোহিত পাহানরা। অনেক পরে ব্রিটিশ আমলে ধানবাদ জেলার অন্তর্ভুক্ত পাঁড়রা গ্রামের এক রাজবংশ এই বিস্তীর্ণ জঙ্গলভূমির রাজা হন। তারাই সম্ভবত তখনকার পাহান পুরোহিতকে সরিয়ে দিয়ে নিকটবর্তী ফুলবেরিয়া গ্রামের চক্রবর্তী ব্রাহ্মণদের সেবায়েত নিয়োগ করেন। তখন থেকে নবকুমার চক্রবর্তী থেকে শুরু করে তাঁর উত্তর পুরুষেরা এখন মন্দিরে পৌরহিত্য করছেন।

এখানে পাথর নির্মিত একটি বলির স্থান রয়েছে। বলির পাথরটির সামনে মাটিতে প্রোথিত একটি কারুকার্য করা প্রাচীন পাথরের ভগ্ন টুকরো দেখা যায় যা ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।

এখানে পুজোতে বলি হয় না, কিন্তু মানসিকের বলি হয়। স্বয়ং পুরোহিত নিজেই বলি দেন। নিত্যপুজো ছাড়াও, এখানকার বাৎসরিক পুজো শুরু হয় মাঘী পূর্ণিমাতে। সাত দিন ধরে চলে মুক্তাইচণ্ডী মেলা। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থীতে হয় হোম। প্রতি দিনই বাউল গান, কবিগানের আসর বসে।

ঢেলাই চন্ডী:

ঢেলাই চন্ডীও বাংলার এক লৌকিক দেবতা। 'ঢেলমারা দেবতা' বা 'ঢেলহাই বাবা' নামেও তিনি পরিচিত। খেজুর গাছ বা তেঁতুল গাছ বা অন্য কোন গাছে ঢিল দিয়ে ঢেলাই চন্ডীর পুজো করা হয়। হয়ত ঢিল থেকেই ঢোলাই নামের উৎপত্তি। একদা নৈহাটি স্টেশন থেকে খানিক দূরে উত্তর-পূর্ব দিকে গোয়ালফটক পল্লী একটি খেজুর গাছকে ঢিল দিয়ে পুজো করতে দেখেছিলেন শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। হালিশহর ,কাঁচরাপাড়া প্রভৃতি জায়গায় ঢেলাই চন্ডীর পুজো হয়।

পুজোয় নৈবেদ্য হিসেবে গাছে নীচে এক টুকরো ঢিল ছুঁড়ে দেয়া হয়। অনেকে দুধ, ফল, টাকা নিবেদন করেন। ব্রাহ্মণ ডেকে দেবী চণ্ডীর ধ্যান মন্ত্রে ঢেলাই চন্ডীর পুজো করা হয়। যাদের শিশু সন্তান খুব কাঁদে তারা ঢেলাই চণ্ডীর কাছে মানত করেন। অনাবৃষ্টি থেকে মুক্তি পেতে কৃষকেরাও ঢেলাই চন্ডীর পুজো করেন।

উলাই চণ্ডী:

উলাই চণ্ডী হলেন নদিয়া জেলার উলা (আধুনা নাম বীরনগর) গ্রামের একজন লৌকিক দেবী। মনসামঙ্গলের কাহিনী অনুসারে প্রায় পাঁচশো বছর আগে উলা গ্রামের পাশে দিয়ে বয়ে যাওয়া, গঙ্গা নদী পথে বাণিজ্য করতে যাচ্ছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ বণিক রাজা চাঁদ সদাগর। শোনা যায়, চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যতরী সপ্তডিঙা সে সময় পাথরে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়।

এরপরেই স্বপ্নাদেশ পান চাঁদ সদাগর। তারপরই উলা গ্রামে শিলাখণ্ড প্রতিষ্ঠা করে মা চন্ডীর আরাধনা শুরু করেন চাঁদ সদাগর। তখন থেকেই বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে মা উলাই চণ্ডীর আরাধনা প্রচলন হয়েছে।

"২৮ বৈশাখ ৯ মে রবিবারে বৈশাখী পূর্ণিমাতে মোং উলাগ্রামে উলাই চণ্ডীতলা নামে একস্থানে বার্ষিক চণ্ডীপূজা হইবেক।.....অনেক স্থানে বারঞয়ারি পূজা হইয়া থাকে কিন্তু এইক্ষণে উলার তুল্য কোথাও হয় না।" - এই মর্মে ১২২৬ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮১৯ সালের ২৭শে বৈশাখ 'সমাচার দর্পণ' পত্রিকায় প্রকাশিত উলাই চণ্ডী পুজোর সংবাদ এবং বিবরণী প্রকাশিত হয়েছিল।

১৮২৪-২৫ সালে প্রকাশিত উলার দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের 'গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিনী' কাব্যে রয়েছে:

অম্বিকা পশ্চিম পারে, শান্তিপুর পূর্বাধারে,
        রাখিল দক্ষিণে গুপ্তিপাড়া,
উল্লাসে উলায় গতি, বটমূলে ভগবতী,
        চণ্ডিকা নহেন যথা ছাড়া।
বৈশাখেতে যাত্রা হয়, লক্ষ লোক কম নয়,
       পূর্ণিমা তিথিতে পুণ্যচয়,
নৃত্য গীত নানা নাট, দ্বিজ করে চণ্ডিপাঠ,
        মানে যে, মানস সিদ্ধ হয়।

একসময় উলা-বীরনগরে সবচেয়ে জনপ্রিয় পুজো ছিল এই পুজো, কিন্তু কালের নিয়মে এর ব্যাপ্তি কমে এসেছে। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের পূর্ণিমায় দেবীর বারোয়ারি সর্বজনীন বার্ষিক পুজো হয়ে থাকে। বাংলায় বৌদ্ধযুগ তথা প্রাক-বৌদ্ধ আমলে বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে হাড়ি জাতির অধিবাসীরা প্রথমে শুয়োর বলি দিয়ে বটবৃক্ষমূলে শিলাখণ্ডে চণ্ডীদেবীর পুজো দিত। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণরা ও জমিদাররা বহু মন্দির ও দেবদেবী প্রতিষ্ঠা করলেও লোকায়ত এই দেবীর পূজার্চনাকে নির্মূল করতে পারেননি। প্রাক-বৌদ্ধযুগের বাংলার লোকায়ত ধর্মাচরণের সঙ্গে এই দেবীর পুজো মিশে গিয়েছে, আজও এই বঙ্গে উলাই চণ্ডীর পুজো হয়ে চলেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...