দীপাবলির পরও উৎসবের আলো কোন শিবিরে স্থায়ী হবে?

ভাইফোঁটা শেষ, কিন্তু বাঙালির উৎসব  শেষ হয়নি এখনও। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মধ্যেই আগামীকাল শনিবার আইএসএলের প্রথম কলকাতা ডার্বি। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ নিয়ে তুঙ্গে উত্তেজনা। পাড়ায় পাড়ায় সমর্থকদের টিকিট জোগাড়ের ব্যস্ততা, এখন টিকিট শেষ, শুধু মাঠে নামার অপেক্ষা।

প্রথম দুটো ম্যাচ হারের পর শেষ ম্যাচে নর্থ ইস্টকে হারিয়ে লাল-হলুদ শিবির এখন উত্তেজনায় ফুটছে। যে আত্মবিশ্বাস পাওয়া গিয়েছে মরসুমের প্রথম জয় পেয়ে, সেটা কাজে লাগিয়েই ডার্বি থেকে তিন পয়েন্ট আদায় করতে চান কোচ স্টিভন কনস্ট্যান্টাইন। তবে এটাও জানেন, প্রতিপক্ষ এটিকে মোহনবাগান আগের ম্যাচে কেরল ব্লাস্টার্সকে পাঁচ গোল দিয়েছে। ফলে তারাও মানসিক ভাবে ভাল জায়গায়। সে কারণে কিছুটা হলেও সতর্ক ব্রিটিশ কোচ।

ইস্টবেঙ্গলের মিডিয়া টিমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডার্বি প্রসঙ্গে কনস্ট্যান্টাইন বলেছেন, "আমার কাছে সব ম্যাচই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটা বলাই বাহুল্য, বড় ম্যাচের আলাদা মাহাত্ম্য আছে। আমরা একটা জয় ও অনেকটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে এই ম্যাচে নামব। এই মরসুমে এটা আমাদের চতুর্থ ম্যাচ হতে চলেছে। এটুকু বলতে পারি, ক্রমশ আমরা উন্নতি করছি। দলের খেলোয়াড়রাও এখন একে অপরের ভূমিকা সম্পর্কে আগের চেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল। আমরা প্রত্যেকে ডার্বি খেলার জন্য মুখিয়ে আছি। আশা করি শনিবার আমরা তিন পয়েন্ট নিয়েই মাঠ ছাড়ব।"

নর্থ ইস্ট ম্যাচের জয় নিয়েও এ দিন মুখ খুলেছেন কনস্ট্যান্টাইন। বলেছেন, "নর্থ ইস্ট ম্যাচের আগে আমরা এক সপ্তাহ ধরে বেশ কঠোর অনুশীলন করেছি। খেলোয়াড়দের পাশাপাশি কোচেরাও প্রচুর পরিশ্রম করছে। একটি দলে ম্যাচ ও অনুশীলন ছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে। বিরতির সময়টা আরও ভাল ভাবে কাজে লাগিয়েছি। খুব বেশি সময় পাওয়া যায় না ঠিকই। তার মধ্যেই সেই ম্যাচে খেলোয়াড়দের বলেছিলাম, প্রথমার্ধের দাপট যেন দ্বিতীয়ার্ধেও বজায় থাকে। আমাদের প্রতিপক্ষ দু'খানা ভাল সুযোগ তৈরি করেছিল। আমরা ওদের গোল করতে দিইনি। দ্বিতীয়ার্ধে আমরা খুব ভাল শুরু করি এবং কিরিয়াকু অনবদ্য একটি গোল করে আমাদের ২-০ এগিয়ে দেয়। ওই গোলটার পরেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে আমরা তিন পয়েন্ট পাচ্ছি।"

নর্থ ইস্টের বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্তে রক্ষণের ভুলে গোল খেয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। যদিও ম্যাচের পরে স্টিভন দাবি করেছিলেন, তিনি একেবারেই চিন্তিত নন। বলেছিলেন, ''গোল খাওয়াটা নিছকই দুর্ঘটনা। নিজেদের ভুলেই গোল খেয়েছি। আসলে ম্যাচের শেষ দিকে ছেলেরা একটু অসতর্ক হয়ে পড়েছিল। শেষ দিকে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় ওদের মনঃসংযোগেও ব্যাঘাত ঘটেছিল। এই নিয়ে আর বেশি ভাবছি না।'' রক্ষণ নিয়ে স্টিভনের চিন্তা যে রয়েছে, তা অনুশীলনেই স্পষ্ট। আলাদা করে কথা বলছেন ডিফেন্ডারদের সঙ্গে। তাঁদের ভুল-ত্রুটি শুধরে দিচ্ছেন।

রক্ষণ নিয়ে স্বস্তিতে নেই মোহনবাগান কোচও। কেরলের বিরুদ্ধে ৫-২ গোলে জিতলেও খুব একটা ছন্দে ছিলেন না ডিফেন্ডাররা। রক্ষণের ভুলেই তিনটি গোল খেতে হয়েছিল। গত কয়েক দিন ধরে রুদ্ধদ্বার অনুশীলনে এই ভুলত্রুটি শুধরে নিতেই মরিয়া ছিলেন জুয়ান।

কলকাতা ডার্বি প্রথম বার খেলবেন পেত্রোতোস। কিন্তু এটাই তাঁর প্রথম ডার্বি নয়। তাই বেশি চাপ নিচ্ছেন না তিনি। পেত্রোতোস বলেছেন, ''এর আগে অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরবে খেলার সময় অনেক ডার্বি খেলেছি। এই ম্যাচের উত্তাপ জানি। সমর্থকরা এই ম্যাচের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁদের জন্য ভাল খেলতে চাই।''

কেরলের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করায় তাঁর উপর সবার নজর থাকবে। কিন্তু এই ম্যাচকে আর পাঁচটা ম্যাচের মতোই নিচ্ছেন পেত্রাতোস। কারণ তিনি জানেন, শুধু একটা ম্যাচ জিতলে আইএসএল জেতা হবে না। তার জন্য প্রতিটি ম্যাচ জিততে হবে। পেত্রাতোস বলেছেন, ''এটা আরও একটা ম্যাচ। জেতার জন্যই নামব। কিন্তু আমাদের শুধু একটা ম্যাচের দিকে তাকালে হবে না। পুরো লিগের দিকে তাকাতে হবে। আইএসএল জেতার চেষ্টা করতে হবে।''

দলে তিনি ছাড়াও গোল করার অনেক লোক রয়েছে বলে মনে করেন পেত্রাতোস। তাই তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করলেও বিপক্ষ বিশেষ সুবিধা করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ''খেলা দেখতে অনেক সমর্থক আসবেন। আশা করছি, তাঁরা হাসি মুখে বাড়ি যেতে পারবেন।''

অন্য দিকে ডার্বিতে নামার আগে আত্মবিশ্বাসী বুমোস। তিনি বলেছেন, "কেরল ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ভাল ফলের পরে আমরা আত্মবিশ্বাসী। ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে এই ম্যাচটা অন্যান্য ম্যাচের থেকে আলাদা। তার উপরে এ বার আমরা সমর্থকদের সামনে খেলব। ফলে আশা করছি, ম্যাচটা খুবই ভাল হবে। আমরা এই ম্যাচে ভাল খেলার জন্য তৈরি।"

আসন্ন ডার্বির সব টিকিট শেষ শুনে খুবই খুশি বুমোস। তিনি বলেন, "ভরা গ্যালারির সামনে খেলার অভিজ্ঞতা অন্য রকম। প্রচুর সমর্থক আসবেন। তাঁদের খুশি করার জন্য আমাদের ভাল একটা ম্যাচ উপহার দিতেই হবে। শনিবার ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে নিজেদের সেরাটা দেব। আশা করি, সমর্থকদের হতাশ করব না। তাঁরা ম্যাচ জেতার আনন্দ করতে করতে বাড়ি ফিরবেন।"

ম্যাচের আগে কিন্তু নিজেদের এগিয়ে রাখতে পারছেন না সবুজ-মেরুনের প্রীতম কোটাল। ইস্টবেঙ্গলকেও এগিয়ে রাখছেন না তিনি। তাঁর মতে, বড় ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা ৫০-৫০।

বড় ম্যাচের চার দিন আগে প্রীতম বলেছেন, ''আমরা তৈরি। দলের সকলেই আত্মবিশ্বাসী। তবু ইস্টবেঙ্গলকে হালকা ভাবে নেওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। ওদের রক্ষণ এবং আক্রমণ বেশ ভাল। যথেষ্ট শক্তিশালী দল। তা ছাড়া বড় ম্যাচ সব সময় আলাদা। সব সময় ৫০-৫০। কে শক্তিশালী, কে দুর্বল— এ সবের কোনও গুরুত্ব নেই।'' আইএসএসের শেষ ম্যাচে কেরল ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে জয় পেয়েছে মোহনবাগান। কোচিতে হ্যাটট্রিক করেছেন দিমিত্রি পেত্রাতোস। অ্যাওয়ে ম্যাচে জয় আসায় আত্মবিশ্বাসী জুয়ানের ছেলেরা। শেষ ম্যাচে নর্থ ইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে জয়ের পর চাঙ্গা স্টিভন কনস্ট্যানটাইনের ছেলেরাও।

ডুরান্ড কাপে মরসুমের প্রথম বড় ম্যাচে জয় পেয়েছিল মোহনবাগান। তবে সেই ম্যাচে মোহনবাগান গোল করতে পারেনি। ইস্টবেঙ্গলের সুমিত পাসির আত্মঘাতী গোলে জয় এসেছিল। এটাও শনিবারের বড় ম্যাচকে মোহনবাগান ফুটবলারদের হালকা ভাবে না নেওয়ার বড় কারণ। তবু তিন পয়েন্টের লক্ষ্যে ঝাঁপাতে চায় সবুজ মেরুন ব্রিগেড। প্রীতমের বক্তব্য, ''সব ফুটবলারই ডার্বি জেতার লক্ষ্যেই মাঠে নামে। আমরাও তিন পয়েন্ট পাওয়ার চেষ্টা করব। মাঠে নামার জন্য আমরা তৈরি।''

ইস্টবেঙ্গলকে হারাতে কোনও বিশেষ পরিকল্পনা কি রয়েছে? ভাঙতে চাননি প্রীতম। তিনি বলেছেন, ''প্রতি দিন যেমন অনুশীলন হয়, তেমনই অনুশীলন করছি আমরা। প্রতি দিন উন্নতি করতে চাই আমরা। দল হিসাবে এবং ফুটবলার হিসাবে।'' দলের রক্ষণ সংগঠন তাঁরা শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন বলেও জানিয়েছেন প্রীতম।

মোহনবাগানের আরেক ফুটবলার আশিক কুরুনিয়ানও সমীহ করছেন ইস্টবেঙ্গলকে। কুরুনিয়ান বলেছেন, ''ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণ খুব শক্তিশালী। ভাল দল। ওরাও শেষ ম্যাচে জিতেছে। সতর্ক থাকতেই হবে। সব ফুটবলারই চায় মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে গোল করতে। আমিও গোল করতে চাই। কিন্তু এটা কারও হাতে নেই। চেষ্টা তো অবশ্যই করব।'' ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে আইএসএলের পয়েন্ট টেবিলের আরও উপরে ওঠাই লক্ষ্য তাঁর।

অন্যদিকে ডার্বির আগে স্বস্তি ইস্টবেঙ্গল শিবিরে যোগ দিয়েছেন প্রতিশ্রুতিমান হিমাংশু জাংরা। চোট সারিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ব্রাজিলীয় এলিয়ান্দ্রো ডস স্যান্টোসও। সোমবার কালীপুজোর সকালে বৃষ্টির মধ্যেই যুবভারতীর অনুশীলন মাঠে প্রস্তুতিতে নেমে পড়েছিলেন লাল-হলুদ কোচ। ভারতীয় দলের অনূর্ধ্ব-২০ এএফসি এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বের ম্যাচ খেলতে কুয়েত গিয়েছিলেন হিমাংশু। লাল-হলুদ জার্সি পরে আইএসএলের একটি ম্যাচেও খেলেননি তিনি। যদিও তা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নন স্টিভন। কারণ, ডুরান্ড কাপে মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে ৪-৩ গোলে জয়ের ম্যাচে হিমাংশুকে পরিবর্ত হিসেবে নামিয়ে দেখে নিয়েছিলেন স্টিভন। তবে ডার্বিতে প্রতিশ্রুতিমান এই ফরোয়ার্ডকে তিনি শুরু থেকেই খেলাবেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। আরও কয়েক দিন দেখেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি।

ডুরান্ড কাপের ডার্বিতে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ভাল খেলেও ইস্টবেঙ্গলকে হারতে হয়েছিল সুমিত পাসির আত্মঘাতী গোলে। এখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গিয়েছে। আইএসএলে আগের ম্যাচে নর্থ ইস্ট ইউনাইটেড এফসিকে ৩-১ গোলে হারিয়ে চনমনে ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলাররা। চিন্তা ছিল এলিয়ান্দ্রোকে নিয়েই। চোটের কারণে তাঁকে গুয়াহাটিতে নিয়ে যাওয়া হয়নি। ব্রাজিলীয় তারকা পুরোদমেই অনুশীলন করছেন। চোট সারিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠা আর এক ব্রাজিলীয় অ্যালেক্স লিমাকে নর্থ ইস্টের বিরুদ্ধে শুরু থেকে খেলানোর ঝুঁকি নেননি স্টিভন। ডার্বিতে তাঁকে প্রথম একাদশে রেখেই দল গড়ার সম্ভাবনা প্রবল। দেখা যেতে পারে অনিকেত যাদবকেও।

২০১৭ সালে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের অন্যতম সদস্য অনিকেত এই মরসুমেই হায়দরাবাদ এফসি থেকে ইস্টবেঙ্গলে এসেছেন। কিন্তু সম্প্রতি তাঁকে রিজ়ার্ভ দলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন স্টিভন। গুয়াহাটিতেও নিয়ে যাননি। লাল-হলুদ কোচের যুক্তি ছিল, অনিকেতকে বেশি খেলার সুযোগ দিতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা তা মানতে রাজি নন। গণমাধ্যমে ক্ষোভ উগরে দেন। অনিকেত ফের মূল দলের সঙ্গেই ডার্বির প্রস্তুতিতে নেমে পড়েছেন।

আর পাঁচটা ফুটবল ম্যাচের থেকে অনেকটাই আলাদা বড় ম্যাচ। লাখ লাখ সমর্থকের প্রত্যাশার চাপ সামলে যে দলের ফুটবলাররা পারফরম্যান্স করতে পারেন, তাঁদেরই সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি থাকে। এখন দেখার দীপাবলির পরও উৎসবের আলো কোন শিবিরে স্থায়ী হয়।

নিবন্ধকারঃ ঋদ্ধি রিত

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...