এসো হে বৈশাখ, এসো এসো

তুলো উড়ছে। শিমুল তুলো। তুলোর গুছির নীচে বীজ। ভবিষ্যতের।

চৈত্রের কাঠফাটা রোদে রাশি রাশি শিমুল ফল ফেটে গাছে ঝুলছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন ফোকলা মুখে হেসে হেসে বলছে, এই দ্যাখো, হবু ছানাদের নববর্ষে বৈশাখী শুভেচ্ছা জানিয়ে জমিনে পাঠিয়ে দিলুম। বললুম, বলতে বলতে যা—গিয়ে এক একটি মহীরুহ হব, সবুজ জাগিয়ে রাখব, শিমুলের দিন বাঁচিয়ে রাখব!...

বাহ, বেশ রেজোলিউশন তো! আমরা ইংরিজি নিউ ইয়ারে রোজা রাখার মতো করে ফি-বছর কতশত হ্যানাত্যানা রেজোলিউশন রাখি; কিন্তু রোজার মতো পালন করতে পারি না। ভাগ্যিস, শিমুল মানুষ না। নেহাত বাঙালিও না। তাই রেজোলিউশন ভাঙে না, বাংলা নববর্ষও ভোলে না।

শিমুল শিক্ষক। শিমুল ব্যঞ্জনাময় কবিতা। শিমুল শেখায় নতুন বছরকে কীভাবে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে হয়, কীভাবে সৃষ্টিমুখর করে রাখতে হয়। নতুন বছরে সে মানুষের মতো একক একা শুভেচ্ছাবার্তা পাঠায় না। শুভেচ্ছাবার্তা তার উদ্বেলিত সর্বাঙ্গে সাজিয়ে রাখে। সকলেই তা চকিত চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে। আগন্তুক বৈশাখকে বরণ করতে সে মহানন্দে পরিধান করে সোনালি-সবুজের নয়নাভিরাম বসন। দাবদাহমুখর বৈশাখের প্রতি তার এতটুকুও বিরক্তি নেই।

আমাদের রবীন্দ্রনাথ, তিনি ছিলেন বড়ই শাল্মলিক। তাই বৈশাখকে তিনিও সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ’।

বৈশাখের পতাকাবাহীও রয়েছেন অনেক। তাঁদের দেখা মেলে ট্রেনে, বাসে, রাস্তার মোড়ে। চৈত্রের মাঝামাঝি হতে। ফিরিওলা তাঁরা। তাঁদের হাতে শোভা পায় গোলাপি-লাল মলাটমাখা পঞ্জিকা। লহমায় এই বর্ষ-পরিচয়ের মলাটের রঙের সঙ্গে আমাদের শৈশবের ‘বর্ণ পরিচয়’-এর মলাটের স্মৃতি-রঙ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আবেগের পালে হাওয়া লাগে। প্রজন্মের কানে কানে বলি সেই গোপন আবেগ।

বলি, শোন বাছা, মনে রেখো, আমাদের ‘শুভ বিজয়া’ বছরে দু’বার। ‘বিজয়া দশমী’ আর ‘পয়লা বৈশাখ’। ফেলে আসা বছর জুড়ে কত কঠিন, কত বিস্বাদ, কত বিয়োগবিধুর জীবনযুদ্ধ জয় করতে পেরেছি বলেই না, আজ এই এখন, এখনও টিকে আছি। অশুভর রাহুগ্রাস পেরিয়ে এই নবীন বছরে পুরনো সূর্য নতুন করে দেখার সুযোগ পেয়েছি। জীবন যুদ্ধের চেয়ে বড় যুদ্ধ আর কোথায়! তাই ‘পয়লা বৈশাখ’ আমাদের কাছে আর-এক ‘শুভ বিজয়া’র দিন। বড়দের পায়ে প্রণতি জানিয়ে শুভেচ্ছা নেওয়ার দিন।

মিডিয়াম মিডিয়াম খেলায় সমাজ এগোচ্ছে। দিন গড়াচ্ছে। গড়াক। আমাদের গাঁ-ঘরের লোনালাগা দেওয়ালে ঘড় ঘড় ফ্যানের হাওয়ায় এখনও পত পত করে ডানা আছড়ায় ছ-পেজি বাংলা ক্যালেন্ডার। আমাদের জীবনে বারব্রতের হিসেবে, ওর ছেলের বয়স, তার মেয়ের বয়সের হিসেবে, কামিন-মুনিষের কাজের হিসেব লেখা খাতায়, মুদির দোকানের ফর্দে, গোয়ালার দুধের হিসেব লেখা খাতায়, বিয়ে-উপনয়ন-অন্নপ্রাশনের কার্ডে, ওঁ গঙ্গা চিঠিতে বাংলা বার, বাংলা তারিখ, বাংলা বছর এখনও দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে।

যা আছে, তাই সত্যি। তাই-ই সুন্দর। এও শেখায় শিমুল। ম ম করা গন্ধ না থাক, পাগল করা টুকটুকে লাল রঙটি তো তার আছে! সে যে একদা আসবেই—এমন আন্তরিক বিশ্বাসময় আনন্দবিধুর অপেক্ষাও আছে। এ-ই বা কম কী

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...