স্বাধীনতা সংগ্রাম ও কুখ্যাত সেলুলার জেল

১৯৩০-৩১ সাল নাগাদ সহিংস ও অহিংসপন্থায় স্বাধীনতা আন্দোলনের যে জোয়ার এল, তাতে প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়া ব্রিটিশ শাসকের সমস্ত জেল প্রায় উপচে পড়ল। তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, সহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের পাঠানো হবে আন্দামানে। দ্বীপান্তরে।

আন্দামানে ইতোমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে প্রায় সাতশো সেলওয়ালা এক সুবিশাল জেল, সেলুলার জেল। কুখ্যাত হওয়ার মতো তার সবরকম গুণই রয়েছে। দিন ফুরোলে সেখানে আলোর ব্যবস্থা নেই, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের কোন পন্থা নেই। 

সেখানকার বন্দিজীবনকে দাসজীবন করে তোলার সমস্ত রকম ব্যবস্থাই সযত্নে রাখা হয়েছে। প্রতিটি সেলের জন্য বরাদ্দ কেবল একটি জলের কলসি, কুটকুটে দুই কম্বলের বিছানা, অখাদ্য খাবার। সেই খাবারের আবার শ্রেণিবৈষম্যও রয়েছে। 

তিনতলা জেল। তিনটি তলা, আসলে তিনটি শ্রেণি। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়। তিনটি শ্রেণির জন্যই কমন খাবার হচ্ছে—অর্ধেক ভাত, অর্ধেক রুটি আর সেদ্ধ-না-হওয়া অড়হরের ডাল, কোনদিন জঙ্গলের ঘাসপাতার সবজি। এর সঙ্গে শুধু প্রথম শ্রেণির সেলের বন্দিদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ-একফালি পাউরুটির টোস্ট।

FotoJet1

খাদ্যতালিকাটি এমন সুচারুরূপে প্রস্তুত যে, তা ক্রনিক পেটের রোগ আর আমাশা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যেন হয়ে ওঠে একেবারে আদর্শ। 

জেলটিও শাসকের চোখে একেবারেই আদর্শ। ত্যাড়া বিপ্লবীদের একবার এখানে এনে ফেলতে পারলেই সব ঠাণ্ডা। পালাবার কোন উপায় নেই। চারিদিকের সহস্র যোজন নোনা জল, লোকালয়ে ব্রিটিশের নৃশংস চোখ আর জঙ্গলে আদিম উপজাতিদের হিংস্র বিষমাখা তিরের কবল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে মূল ভূখণ্ডে ফেরাটা শুধু অভাবনীয় নয়, অসম্ভব।       

কলকাতা থেকে বন্দিদের নিয়ে যাওয়ার একমাত্র পরিবহনব্যবস্থা, জাহাজ। ‘মহারাজ’ ও ‘সাজাহান’-নামের দুটি জাহাজ। একটি যখন আন্দামানে পৌঁছয়, তখন অন্যটি কলকাতার বন্দরে এসে ভেড়ে।

১৯৩২ সালের আগস্ট মাস। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার সাজাপ্রাপ্ত তেইশ জন বন্দিকে দিয়ে আন্দামানে দ্বীপান্তরের সূচনা হল। বন্দিদের মধ্যে রইলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, ফণী নন্দী, অনন্ত সিং প্রমুখ নেতাকর্মীরা। 

যে-দিন তাঁদের কলকাতা বন্দর থেকে জাহাজে তোলা হল, সে-দিন সমস্ত রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়া হল। সেই অবাধ নির্জনতার মধ্য দিয়ে আমজনতার সম্ভাব্য সমস্ত প্রতিরোধের পথ বন্ধ করে বিপ্লবীদের নিয়ে যাওয়া হল জাহাজে। 

প্রতিরোধ হওয়ারই তো কথা। কারণ, সাধারণ মানুষ, বিপ্লবী ও বন্দি—সবারই ধারণা যে, সমস্ত বন্দিকেই আন্দামানে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হবে সমুদ্রের লোনা জলে। আর সেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নির্যাতনের কথা ভারতের মূল ভূখণ্ডে এসে পৌঁছবে না। এভাবেই বন্ধ করে দেওয়া হবে এর বিরুদ্ধে সংঘটিত সমস্ত প্রতিবাদ আন্দোলন।

FotoJet2

শাসক ইংরেজের ইচ্ছেয় কয়েকদিনের মধ্যেই জাহাজের অবাধ আনাগোনায় ভরে উঠল আন্দামানের জেলের কুঠুরিগুলো। দেখা গেল, সেখানে কাউকেই গুলি করে মেরে ফেলা হল না। কিন্তু তার বদলে বন্দিদের এমন এক অসহনীয় নির্যাতিত জীবনের গণ্ডিতে আটকে দেওয়া হল, যার তুলনায় মৃত্যুও হয়তো ভালো! 

কিছুদিন সেখানে কাটানোর পর একে একে অসুস্থ হয়ে গেলেন অনেকেই। হয়ে গেলেন রুগ্ন-মুমূর্ষু। 

ওই অখাদ্য খাবার খেয়ে সারাদিন নারকেলের ছিবড়ে তৈরি করে, তা থেকে দড়ি তৈরির অক্লান্ত পরিশ্রম করে, জিরোবার ফুরসতে মার খেয়েও রাত্রে নিশ্চিন্ত-নিদ্রার কোন উপায় নেই। সন্ধ্যে থেকে নিকষ অন্ধকার সেলে ঢুকে অসহ্য অসংখ্য মশার কামড়ে আর যাই হোক নিদ্রা আসে না। নীচের তলার বন্দিদের জন্য বাড়তি উৎপাত কালান্তক কাঁকড়া বিছে। তার দংশনের জ্বালায় অনেকেরই জীবন সংশয় হতে লাগল। 

এই জীবন বয়ে আর কাঁহাতক টিকে থাকা যায়! চরম অতিষ্ঠ হয়ে বন্দিরা একদিন একস্বরে জানালেন শুধু তিনটি মাত্র সাধারণ দাবি-খাবার যোগ্য খাদ্য, রাতের জন্য আলো আর পড়বার জন্য দু’একটি বই ও পত্রিকা। 

যথারীতি তাঁদের সেই দাবি জেল কর্তৃপক্ষ গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলেন না। তখন মরিয়া হয়ে সবাই মিলে এই দাবিগুলো নিয়ে আমরণ অনশন করার কথা ভাবলেন। দু’একজন ছাড়া সকলেই একমত হলেন। শুরু হল অনশন। 

অনশনে জল খাওয়া যায়, খাবার নয়। দিন সাতেক খাবার না-খেয়ে বেশির ভাগ বন্দিই দুর্বল হয়ে পড়লেন। 

কিন্তু এত সহজে হার মানবে, এত সহজে তাঁদের মরতে দেবে ইংরেজ সরকার, তাও কী হয়! ফলে, অনশনকারীদের নাকে নল ঢুকিয়ে দুধ খাওয়ানো চেষ্টা করল। তাতে ফুসফুসে দুধ ঢুকে জীবন আরও সংকটগ্রস্ত হয়ে গেল। কিন্তু এতেও যখন অনশন বন্ধ করা গেল না, তখন বন্দিদের টাইট দিতে জেল কর্তৃপক্ষ জল দেওয়াও বন্ধ করে দিল।

FotoJet3

অচিরেই জলের জন্য হাহাকার শুরু হল। তখন তারা জলের বদলে কলসিতে দুধ রেখে দিল। বন্দিরা সেই দুধের কলসি ভেঙে দিলেন, তবু অনশন প্রত্যাহার করলেন না। 

ব্রিটিশের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে কোন এক ফাঁকে এই দুর্দমনীয় অনশনের কথা সাগর পেরিয়ে বাতাসের কানে কানে অবশেষে পৌঁছে গেল ভারতের ঘরে ঘরে। রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবীদের কাছে বিপ্লবের স্বার্থে জীবনধারণ করার অনুরোধ জানিয়ে অনশন ভঙ্গের প্রার্থনা জানালেন টেলিগ্রাম করে। 

ভারত সরকারের কাছে চাপ সৃষ্টি করতে লাগলেন সমস্ত বড় বড় নেতারা। এই পরিস্থিতিতেও সমস্ত চাপকে উপেক্ষা করে জেল কর্তৃপক্ষ সমস্ত দাবিকে অগ্রাহ্য করে বিনা শর্তে অনশন প্রত্যাহার করানোর অনড় মনোভাব থেকে এক চুল সরে আসতে রাজি হল না। 

শাসকের টানাপোড়েনে অনশন যখন তিয়াত্তর দিন পার করল, তখন ক্রমাগত চাপ আর দুর্দমনীয় অনশনব্রতের সামনে ব্রিটিশ শাসক এবং সেলুলার জেলের কর্তৃপক্ষ অবশেষে বন্দিদের কাছে মাথা নত করল। ততদিনে এই সংগ্রামে আত্মত্যাগ করেছেন তিনজন বীর—মহাবীর সিং (লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা), মোহিত মিত্র (অস্ত্র আইন মামলা), মোহন দাস (ময়মন সিংহ ষড়যন্ত্র মামলা)

তিন বীরের আত্মত্যাগ এবং সমবেত অনমনীয় লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিকেরা নিজেদের কাঙ্ক্ষিত দাবি আদায় করে নিলেন। জেল কর্তৃপক্ষ ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে আলু-পেঁয়াজ ইত্যাদি আমদানি করে বন্দিদের খাবারের মান উন্নত করার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হল। প্রতিটি সেলে বৈদ্যুতিক আলো লাগানোর কাজ শুরু করল। এবং, নিজের পয়সায় বন্দিরা পত্রপত্রিকা ও বই আনিয়ে পড়ার সুযোগ পেলেন। 

সমগ্র ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তাঁদের এই ‘দাবি’ আদায় করে নেওয়ার সংগ্রাম ও তার সফলতা সংগ্রামী ও বিপ্লবীদের ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করল, তাঁদের ‘বৃহত্তর দাবি’ আদায়ের স্বপ্নকে ধীরে ধীরে আরও জোরদার করে তুলল—এর সঙ্গে পনেরই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির তাই সোপান–সম্পর্ক আছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...