প্রতিদিন বুলেট এড়ানোর লড়াই। প্রতিরাতে বোমার আতঙ্ক। রোজ-রোজ রক্তে ভিজে বদলে গিয়েছে মাটির রং। তবু মানুষ বাঁচে সেখানে। যেভাবে সিরিয়ার মানুষ বেঁচে আছে।
একটা ভূ-খন্ড বছরের পর বছর ধরে অবরুদ্ধ। বেঁচে থাকার সংজ্ঞা সীমাবদ্ধ হয়ে আসে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইতে। এমন একটা ভূ-খণ্ডে মানুষের বই এর প্রতি আগ্রহে প্রশ্নচিহ্ন চলে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু সিরিয়ার ভূ-গর্ভস্থ পাঠাগার সে কথা বলে না। যুদ্ধের অন্ধকারের মধ্যেও যাতে মানুষের কাছে কিছু আলো পৌঁছে দেওয়া যায় তার জন্য পাঠাগারে রাশি রাশি বই।
বই পাগলরা বুলেট বোমাকে তুচ্ছ করে প্রতিদিন পৌঁছে যায় সেখানে।
পাঠাগারটি মাটির নিচে। খাড়া সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলে একটা বড়সড় ঘর। টিমটিমে আলো। এই ঘরেই পাঠাগার। রিডিংরুম। পাঠাগারটি যারা তৈরি করেছেন তাদেরই একজন আনাস আহমেদ। সিরিয়ার দামাস্কাসের মানুষ। তার শহর দারাইয়া।
কীভাবে গড়ে উঠল পাঠাগার সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা দেখলাম যে এই ভাঙ্গা শহরে কিছু অন্তত বইএর ব্যবস্থা করা উচিত। যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোনও ভাবে পড়াশোনাটা করতে পারে। তাদের হাতে বই তুলে দিতে হবে। গোটা শহরটাই ধ্বংসের পথে। বোমা আর শেলে যাতে এই পাঠাগার ধবংস না হয়ে যায় তার জন্য মাটির নিচে তৈরী করা হয়েছে এটি।
বছর সাতেক আগে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল- আসাদের সেনারা দারাইয়া অবরোধ করে।
তারপর থেকে আনাস আর তার দুই বন্ধু সহযোদ্ধা মিলে ২০১১ সাল থেকে বই সংগ্রহের কাজ শুরু করে। প্রথম দফায় তারা প্রায় ১৪ হাজার বই সংগ্রহে করতে সক্ষম হয়। পরে সংগ্রহ আরও বাড়ে। প্রতিটা বিষয়ে তাদের বইয়ের সংগ্রহ অকল্পনীয়।
শুধুমাত্র যুদ্ধ হিংসার কারনে সিরিয়ায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা। মর্টার হানায় গুঁড়িয়ে গিয়েছে স্কুল। সেই সব ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছে বই সংগ্রহের জন্য| যুদ্ধ, হামলা, ভয়, মৃত্যু কোনও কিছুই ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি হাসান আর তার বন্ধুদের। পাঠাগারের বইয়ের তাক ভর্তি করতেই হবে। বইয়ের খোঁজে তারা হামলায় বিধস্ত এলাকা, রাস্তা চষে ফেলেন।
আনাস জানান, “এমনও হয় যে গোলার আঘাতে ভেঙে চুরে ধুলো হয়ে যাওয়া বাড়িগুলোতেও আমরা ধবংসস্তুপ হাতড়েছি। কিছু না কিছু বই ঠিক বেরিয়ে এসেছে। এসব জায়গায় বই সংগ্রহ করা বেশ বিপদজনক।”
আর্মি, বন্দুকধারি, গুলি, বোমা থেকে বাঁচতে লুকিয়ে লুকিয়ে বই জোগাড়ে যেতে হয় আনাসদের। জানতে পারলেই শেষ!
তাই সবটাই খুব সাবধানে। সে কারনেই পড়ুয়ারা পাঠাগারের স্থান ও নিজেদের পরিচয় যতটা সম্ভব গোপন রাখে। তাদের ভয় হামলাকারীরা সন্ধান পেয়ে গেলে এই পাঠাগারও রকেট হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে যাবে। এই ‘সিক্রেট লাইব্রেরি’ শিশুদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। তবু অনেক শিশু শুধু বইয়ের জন্য প্রাণ হাতে নিয়ে এখানে আসে প্রতিদিন। তারা বলে, বেশির ভাগ সময় হামলার আতঙ্কে তারা দরজা জানলা বন্ধ করে ঘরের ভিতরেই থাকে। বাড়ির বাইরে পা রাখতে পারে না। তাদের এক মাত্র সঙ্গী এই লাইব্রেরির বইগুলো।
পড়ুয়াদের পড়ার খিদে আর আগ্রহ দেখে আনাসরা সম্প্রতি একটি ‘কমিউনিটি নিউজপেপার’ বের করার কথা পরিকল্পনা করেছে।
হাজার এক ভয় আর অচেনা আতঙ্ককে বুকে জড়িয়ে বেঁচে আছে এই লাইব্রেরি। সিরিয়ার তরুন প্রজন্মের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে আসলাম নামে এক তরুণের কথায়। সে জানিয়েছে, ঘরের কোণ, বাড়ির ছাদ তাকে যে নিরাপত্তা দিতে পারে না সেই নিরাপত্তা সে পায় মাটির তলায় এই লাইব্রেরিতে। বইয়ের তৃষ্ণা তাকে ওই পাঠাগারের সহকারী গ্রন্থাগারিকের মর্যাদা দিয়েছে।
ভাঙা শহরে বইয়ের চেয়ে পেটের খাবার জোগাড় করা বেশি যুক্তিযুক্ত নয় কি?
এই প্রশ্নের উত্তরে পড়ুয়াদের জবাব, মানুষের মস্তিষ্ক আসলে পেশির মত। বই তাকে আরও শক্তিশালী করে। আলোকিত মস্তিষ্ক মনের খোরাক যোগায়। এই লাইব্রেরি তাদের আবার জীবনে ফিরিয়ে এনেছে।
ওমর আবুআনাস এমনই একজন পড়ুয়া। বয়স ২০ পেরিয়েছে। সে স্কুলের পাঠ শেষ করতে পেরেছে। কিন্তু তাকে যুদ্ধে যেতে হয়। আক্রমণের সম্মুখে থাকতে হয়। সে যখন যুদ্ধে যায় তখন প্রচুর বই নিয়ে যায় সঙ্গে করে। যুদ্ধের অন্ধকার, খোলাটে সময়গুলোতে একহাতে বন্দুক আর একহাতে বই থাকে তার।
আসান আর তার সহযোদ্ধারা এখন বই সংগ্রহে স্কাইপ আর হোয়াটসঅ্যাপকেও কাজে লাগিয়েছে।
যুদ্ধ হিংসার বিরুদ্ধে আনাসরা এভাবেই যুদ্ধ লাগিয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেট তাদের দুনিয়ার অন্য প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগের দরজা খুলে দিয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত হিংসার ঘটনায় প্রতিবাদ জানাচ্ছে আনাসরা। উগ্র হিংসা যে ভয়ংকর হতে পারে তা আনাসরা জানে!