"পিঁপড়ে, শুধু পিঁপড়ে। মস্ত হলঘরের যেদিকে তাকানো যায়, কেবলই পিঁপড়ে। রঙিন পিঁপড়ে-বিরঙ পিঁপড়ে, রাক্ষুসে পিঁপড়ে-লিলিপুট পিঁপড়ে, নিরামিষপ্রিয় পিঁপড়ে-আমীষলোভী পিঁপড়ে, বিষাক্ত পিঁপড়ে-নির্বিষ পিঁপড়ে। কাচের শো'কেসে পিঁপড়ে, জলঘেরা দ্বীপে বন্দী পিঁপড়ে, মাটির তলায় সারি সারি সুড়ঙ্গভর্তি পিঁপড়ে। মোট কথা, পিঁপড়েদের নিয়ে একটা জগৎ। অক্ষয় দত্ত এই জগতের সৃষ্টিকর্তা। পিঁপড়ে সংগ্রহ তার নিছক বাতিক নয়-গবেষনার অঙ্গ। পোকামাকড়ের বিশাল দুনিয়া থেকে কিছু একটা আবিষ্কার করতেই হবে। তাহলেই যন্ত্রযুগের আরও উন্নতি সম্ভব। একেই বলে বায়োনিকস অর্থাৎ বায়োলজি আর মেকানিকস-এর যোগফল।" (অদ্রীশ বর্ধনের লেখা 'পিঁপড়ে'র প্রথম অনুচ্ছেদের অংশ)
-এভাবেই তথাকথিত দুর্বোধ্য, অজানা জ্ঞানকে সহজকথায় সাহিত্যে রূপান্তরিত করে বাংলার পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে ‘কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্যের’র কদর এনেছিলেন যিনি, চলে গেলেন সেই প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিক অদ্রীশ বর্ধন। তাঁর অনূদিত শার্লক হোমস, জুল ভার্ন, এবং এডগার অ্যালেন পো রচনাসমগ্র, তাঁর সৃষ্ট চরিত্রসমূহ- ইন্দ্রনাথ রুদ্র, ফাদার ঘনশ্যাম, প্রফেসর নাটবল্টু চক্র, রাজা কঙ্ক, জিরো গজানন, নারায়ণী, চাণক্য চাকলা -বাংলা সাহিত্যজগতের অবিস্মরণীয় কীর্তি। শুধুমাত্র ছোটদের নয় বড়দের মধ্যেও বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারের কাজে পালন করেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা, এমনকি ‘কল্পবিজ্ঞান’ শব্দবন্ধের জন্মদাতাও তিনি। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ থেকে ২০ মে, সোমবার রাত দেড়টা নাগাদ প্রয়াত হন অদ্রীশ বর্ধন।
১৯৩২ সালের ১লা ডিসেম্বর কলকাতার এক শিক্ষক পরিবারে জন্ম তাঁর। স্বামী বিবেকানন্দের অনুপ্রেরণায় তাঁর ঠাকুরদার স্থাপিত 'হিন্দু বয়েজ স্কুল' নামের এক বিদ্যালয়েই তিনি পান প্রাথমিক শিক্ষা। পরবর্তীকালে বি এস সি -তে ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ করেন। শিবরাম চক্রবর্তীর 'বাড়ি থেকে পালিয়ে' পড়ে অ্যাডভেঞ্চারের টানে কুড়ি বছর বয়সে পালিয়ে গিয়েছিলেন বোম্বে অধুনা মুম্বই-এ। সেখানে গিয়ে টুকটাক চাকরি শেষে চাকরি নেন 'ক্যালকাটা কেমিক্যাল'-এ। পোস্টিং হয় ব্যাঙ্গালোরে। সেই সময় থেকেই পেশাগত লেখালিখির দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন তিনি। ছাপোষা জীবন একেবারেই পছন্দ ছিলনা এই অ্যাডভেঞ্চার-লেখকের। বার বার বাসাবদল, চাকরি পরিবর্তন করতেন তিনি। শেষমেশ চাকরির যাবতীয় অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে ধরে রেখে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসেন কলকাতায়।
ছোটবেলা থেকেই লেখালিখির অভ্যেস ছিল তাঁর, দেওয়াল পত্রিকায় লেখা-আঁকা দিতেন। 'পোড়োবাড়ির খাঁড়া'ই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম লেখা ভূতের গল্প। ১৯৬০ সালে বম্বেতে থাকাকালীন 'উল্টোরথ' পত্রিকার একটি প্রতিযোগিতায় 'আমার বান্ধবী সুনন্দা'-নামে প্রথম গোয়েন্দা গল্প লেখেন, যে গল্পটি জিতে নিয়েছিল প্রথম পুরস্কার।
বিদেশে যখন সাই-ফাই(সায়েন্স ফিকশন)-এর চর্চা চলছে জোরকদমে সেই সময়ে বাংলা সাহিত্যে সায়েন্স ফিকশনের উপর কাজ করছিলেন না প্রায় কেউই। সায়েন্স ফিকশন নয়, তখন বাংলা পাঠক-পাঠিকা'রা অল্পবিস্তর পরিচিত ছিলেন 'বিজ্ঞানভিত্তিক কাহিনী' এমনকি সায়েন্স ফিকশন যে বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক, তা মানতে চাইতেন না অনেক বাংলা সাহিত্যিকরাই। তিনি এসব অচ্ছুত ভাবধারাকে বিদায় জানাতে শুরু করে দেন তোড়জোড়। তিনিই প্রথম সৃষ্টি করলেন 'সায়েন্স ফিকশন'এর বাংলা প্রতিশব্দ 'কল্পবিজ্ঞান' শব্দবন্ধটি শুধু তাই নয়, কল্পবিজ্ঞানই যে 'মহাকাশ যুগের রূপকথা' একথা তিনিই বলেন। তাঁর লেখা 'নিতঙ্ক'ই বাংলায় প্রথম গুপ্তবিজ্ঞান নিয়ে লেখা রোমাঞ্চকর কাহিনী। কল্পবিজ্ঞান নিয়ে লিখতে শুরু করেন ষাট-এর দশকে। "ভূতের গল্প যেমন ভূতেদের জন্য নয়, ঠিক তেমনই কল্পবিজ্ঞানও বৈজ্ঞানিকদের জন্য নয়"-একথা শিরধার্য করেই ১৯৬৩ সালে আকাশ সেন ছদ্মনামে তিনি শুরু করেন ভারতের প্রথম কল্পবিজ্ঞান মাসিক-পত্রিকা 'আশ্চর্য!'। এই পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন তাঁর দাদা ডঃ অসীম বর্ধন। বাংলায় কল্পবিজ্ঞান চর্চাকে তরান্বিত করতে এই পত্রিকার উদ্যোগ ছিল উল্লেখযোগ্য। এই পত্রিকার উপদেষ্টা ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, শিল্প উপদেষ্টা ছিলেন চন্দ্রনাথ দে এবং পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সত্যজিৎ রায়।
'আশ্চর্য!' নিয়ে অদ্রীশবাবু স্মৃতিচারণা করে বলেছিলেন, "প্রথম সংখ্যাটির আত্মপ্রকাশের পর সে কী আলোড়ন, কী রোমাঞ্চ, কী চাঞ্চল্য সাহিত্য মহলে - তেমনি তার আশে পাশে কি উন্নাসিকতা, সতর্কিত সন্দেহ, কত তাচ্ছিল্যের মৃদু হাস্যপরিহাস। অবশ্য সংবাদপত্রের 'ফিচার-কলামে' সপ্রশংস সুরে এই দুঃসাহসের উল্লেখ হলো, শুভেচ্ছার সঙ্গে মূল্যবান পরামর্শ বর্ষিত হলো, উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলো, আশা করা হলো বস্তাপচা সাহিত্যের দুর্গন্ধ দূরীকরণের একটা সঠিক প্রচেষ্টা এবার শুরু হলো।"
'আশ্চর্য!' বন্ধ হয়েছে বহু বছর আগেই, এবার বিদায় জানালেন তিনিও। কিন্তু তাঁর বহুদূর পর্যন্ত দেখার ক্ষমতা, বলিষ্ঠ মনোভাব, অতীন্দ্রিয় জগতকে সর্বজনে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে বাংলা ভাষাসাহিত্যের এবং কল্পবিজ্ঞানের একজন আদর্শ পথিকৃৎ, একজন আশ্চর্য-অবিস্মরণীয় কলমধারী হিসেবে।