মৃৎশিল্পে বাঁকুড়ার খ্যাতি চিরকালীন। ১৮৮৭ সালের ১১ এপ্রিল সেই জেলারই বেলিয়াতোর গ্রামে একটি ছোটখাটো জমিদার পরিবারে জন্ম নেয় এক শিশু। সেই শিশু কথা বলা, হাঁটতে শেখার সঙ্গেসঙ্গেই নিজের গ্রামাঞ্চলে মাটির কারিগরদের কাজ, কাজ করার পদ্ধতি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। সেইসময় থেকেই সেই শিশুর মধ্যে লালিত হতে থাকে এক শিল্পীমন। সেই শিশুই পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠেন শিল্পী যামিনী রায়।
চিত্রশিল্পে বাংলার সংস্কৃতি, লোকআঙ্গিককে নিজের চিত্র-শিল্পকলার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন এই প্রবাদপ্রতিম চিত্রকর। অবশ্য চিত্রকরের থেকে নিজেকে 'পটুয়া' হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করতেন যামিনী। ১৯০৩ সালে ১৬ বছর বয়সে কলকাতায় এসে সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন তিনি। তখন সেখানে অধ্যক্ষ পদে ছিলেন অবনীন্দ্র নাথ ঠাকুর। সেইসময়ে ভারতীয় শিল্পীরা ছবি আঁকার ক্ষেত্রে ইউরোপের অনুকরণ ছেড়ে স্বদেশের শিল্পকলার ঐতিহ্য বোঝার চেষ্টা করছিলেন এবং ছবি আঁকছিলেন প্রাচ্য রীতিতে। ছাত্র থাকাকালীন অবনীন্দ্রনাথ তাঁকে পাঠিয়েছিলেন জোড়াসাঁকো়য় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোর্ট্রেট আঁকতে! আর্ট স্কুলে তিনি যা শিখেছিলেন, সবটাই ছিল গতানুগতিক। ১৯০৮-এ ফাইন আর্টে ডিপ্লোমা শেষে তিনি ঠিক করেন অন্যকোনও রীতি নয়, তৈরী করবেন সম্পূর্ণ নিজস্ব রীতি, নিজস্ব ঘরানা। ছোট থেকে নিজের গ্রামের মাটির কাজের সঙ্গে তাঁর মন বাঁধা পড়েছিল, তাই নিজস্ব সংস্কৃতি অটুট রেখেই তৈরী করলেন নিজের স্বতন্ত্র পথ, বেছে নিলেন বাংলা গ্রামাঞ্চলের লোকশিল্পের পথ ও পদ্ধতি।
কালিঘাটের পটচিত্র প্রভাব ফেলেছিল যামিনী রায়ের মনে। বাংলার শিল্পচর্চা ইতিহাসের সুপ্রাচীন পদ্ধতিতে গুরুত্ব দিয়ে পটের গায়ে আঁকা ছবি, আল্পনার ঢং, মাটির হরেক রকম খেলনা, পুতুল-ঘোড়া-হাতি-মাছ-বিড়াল, দেব-দেবী, পৌরানিক চরিত্র -সবকিছুতেই ফুটে উঠেছিল তাঁর নিজস্ব স্টাইল-ভাবনা-বৈচিত্র্য।
অনেকেরই হয়ত জানা নেই কলকাতার সেন্টপলস ক্যাথেড্রাল গির্জায় রয়েছে যামিনী রায়ের আঁকা একটি ছবি, 'লাস্ট সাপার'। সেই ছবির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেকদিনের ইতিহাস। প্রকৃত অর্থে কলকাতাকে 'লন্ডন' বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ইংরেজ আমলে, পুরনো কলকাতার নিদর্শন যতটুকু রয়ে গিয়েছে, তা সে কথাই বলে। যাই হোক যে কথা বলছিলাম, ইংরেজ উপনিবেশে তাঁরা তাঁদের সুবিধা ও পছন্দ মতো তৈরি করে নিয়েছিলেন একের পর এক তাক লাগানো স্থাপত্যকীর্তি। সেগুলিরই মধ্যে অন্যতম ক্যাথেড্রাল চার্চ। ইরেজদের বানানো সেই স্থাপত্যের সঙ্গে বাঙালির আবেগ, মনন জুড়ে দিয়েছিলেন যামিনী রায়। ষাট-সত্তরের দশকে যীশু'র ভাবধারার সঙ্গে ভারত তথা বাংলার মনের সংযোগ তৈরী করার উদ্দেশ্যে বিশপ এইচ লাকদাসা জে ডেল মেল চাইলেন পাশ্চাত্য শিল্পের সঙ্গে উপাসনা গৃহে থাকবে ভারতীয়-বাঙালি শিল্পীদের ছবি। বিশপ সেই ভাবনা বিশদে আলোচনা করেন যামিনী রায়ের সঙ্গে। যামিনী গির্জার জন্য এঁকে দিলেন 'লাস্ট সাপার'।
তাঁকে লোক আঙ্গিকে বাঁধা হয় ঠিকই, কিন্তু এক্সপেরিমেন্ট কিছু কম করেননি। তেলরং নিয়ে তাঁর শুরুরদিকের একটা এক্সপেরিমেন্টাল ছবি কিনে নিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। একবার এক এগজিবিশনে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছেন, জিভে প্যারালিসিস, কথা বলতে পারেন না। যামিনী রায় দেখলেন, তাঁর আঁকা ছবি দেখে গগনেন্দ্রনাথের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
কখনও এঁকেছেন বাইজেন্টাইনীয় ঘরানায় তাঁর সুবিখ্যাত 'বাইবেল সিরিজ'। মাটি গুঁড়িয়ে তেঁতুল-আঠা বা ডিমের সাদা অংশ মিশিয়ে রঙ বানাতেন। কবি বিষ্ণু দে’র ভাষায়, ‘ধূসর তিনি আনেন নদীর পলিমাটি থেকে, সিঁদুর-রঙ পান মেয়েদের পুণ্যাচারের সিঁদুর থেকে, নীল তো চাষের নীল, আর শাদা হচ্ছে সাধারণ খড়ির রঙ এবং কালো তিনি মেশান সুলভ ভুষো থেকে।’ তাঁর অসামান্য কীর্তি রামায়ণ সিরিজ আঁকেন উত্তর কলকাতার ‘রসগোল্লা ভবন’-এর লম্বা হলঘরে বসে।
খ্যাতি, যশ এসব যামিনীর জীবনে এসেছিল অনেক পরে। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিল্প সবার আগে তার জন্য যা করতে হয় তাই করব। আজীবন সেই কথাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান যামিনী রায়।