শঙ্করনামা

সাহিত্যের পরিসরে এসে পড়েছিলেন খানিকটা হঠাৎ করেই। বারওয়েল সাহেবের সঙ্গে দেখাটাই মোড় ঘুরিয়ে দিল জীবনের।

মিস্টার নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েল। কলকাতা হাইকোর্টের শেষ ব্রিটিশ ব্যারিস্টার।

টাইপিস্ট রেখেছিলেন এক বাঙালি যুবককে। হাওড়ার অখ্যাত গলির বাসিন্দা। ভাগ্যসন্ধানী তরুণটির নাম বদলে দিয়েছিলেন সাহেব। প্রথম দেখাতেই।

দশটা-পাঁচটার টাইপিস্টের জীবন বাঁক বদল করতে করতে একদিন গিয়ে পৌঁছল বিশ্ব সাহিত্যের মঞ্চে। পরিচিতি এসেছিল সাহেবের দেওয়া নামটিতেই। মানুষের মায়া কখন যেন লেগে গিয়েছিল নামের গায়েও। তারপর দরিয়া-জীবন বয়ে চলল সেই নামের টানেই। ‘মণিশংকর’ থেকে ‘শংকর’ হয়ে।

বাবা ছিলেন হাওড়া কোর্টে ওকালতি করতেন। অকালে প্রয়াত হন। সংসার সামলাবার দায় এসে পড়ল মণিশংকরের কাঁধে। পড়া ছাড়তে হল।

চাকরির বড় প্রয়োজন তখন। সংসারের হাল ধরতে রাস্তায় জিনিস ফেরি পর্যন্ত করতে শুরু করলেন। বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে যে লক্ষ্মীর চেয়ে তার সহোদরার যোগ প্রবল।  

সেই যোগেই যেন মাস্টারি পেয়ে গেলেন হাওড়ার বিবেকানন্দ স্কুলে। অঙ্ক থেকে সংস্কৃত কিংবা বিজ্ঞান- সব ‘সাবজেক্টের’ ক্লাসেই দেখা যেতে লাগলে নতুন মাস্টারকে। তবে সে চাকরিও টিকল না।

শেষে একদিন ফেরি পার। দাদা বিভূতির সঙ্গে গিয়ে দেখা করলেন কোর্ট চত্বরের বারওয়েল সাহেবের সঙ্গে। ‘বিভূতিদা’ সেই সাহেবের প্রাক্তন ‘টাইপিস্ট’। ছেড়ে যাওয়া জায়গাটি দিয়ে যেতে চান পরিচিত ভাইটিকে।

ছ ফুট লম্বা। টকটকে ফরসা গায়ের রং। ঝকঝকে গোরা সাহেব ‘ইন্টারভিউ’ নিলেন। গঙ্গা পেরিয়ে সদ্য কোর্ট চত্বরে পা রাখা তরুণটির ধুকপুকানি এমনই যে সাহেবকে ‘গুড মর্নিং’ পর্যন্ত ভুলে গেল সে। সাহেব অবশ্য সে সব ধরলেন না। তবে গোল বাঁধল অন্য জায়গায়।  

এত বড় নাম ধরে ডাকা যায়! একটা ‘পোর্টেবল’ নাম চাই! নাম বদলে দিলেন সাহেব। ‘মণিশংকর’ থেকে ‘শংকর’। আড়ালে হারিয়ে গেল ‘পুরনো নাম’।

মাঝপথে ছাড়তে হয়েছিল পড়াশোনা। পরে জীবন এক্টু থিতু হতে ফের ফিরলেন সিলেবাসের পড়াশোনায়। দিনে কোর্ট চত্বর আর রাতে বঙ্গবাসী কলেজের ক্যাম্পাস।  

ওল্ড কোর্ট স্ট্রিটে আদালতের কাজ শেষ করে সোজা কলেজ। নাইটে ক্লাস করতেন।

প্রথম লেখা শুরু পঞ্চাশের দশকে। অনেকটা যেন ভুয়ো পরিচয় থেকে এড়াতে। আমেরিকান লাইব্রেরিতে ঢুকতে গিয়ে নিজের পরিচয়ে লিখতে হয়েছিল ‘রাইটার’। একটা লাইনও না লিখে লেখক পরিচয় ব্যবহারের কাঁটা যেন খচখচ করছিল সারাক্ষণ। কিছুটা খেদ থেকে বাঁচতেই যেন কলমে হাত পড়ল। ফাইল সামলানো আর সাহেবের কাজের ফাঁকে ফাঁকে লিখে ফেললেন দুটো প্রবন্ধ। পাঠিয়েও দিলেন খবরের কাগজের দফতরে। তবে সে প্রবন্ধ আর প্রকাশিত হল না।

তাতে কী! ততদিনে লেখার নেশা পেয়ে বসেছে।

থেমে গেলেন না। আবার লিখলেন। সেবারও প্রবন্ধ। এবার কিন্তু মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারল না সম্পাদকের দফতর। প্রবন্ধ প্রকাশিত হল বিখ্যাত দৈনিকের পাতায়।

হাওড়ার খুরুট রোড থেকে কোর্ট চত্বর। ভৌগলিক জীবনের পরিসর তখন এতটুকুই। কিন্তু দেখার পরিসর নয়। তাই ওল্ড কোর্ট স্ট্রিটের মানুষগুলো কখন যেন জড়িয়ে গিয়েছিল জীবনের সঙ্গে।

প্রথম-প্রথম শুধু কাজ। কাজ না থাকলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা। বারওয়েল সাহেব বললেন, ‘উঁহু...কথা বলতে হবে। না বললে ছাড়বো না। প্রথমে দু’চারটে ভুল সবারই হয়। ইংরেজী ভাষাটা সোজা নয়।’

কোর্ট চত্বর বদলে দিতে থাকে দেখা। আর বারওয়েল সাহেব। তিনি শুধু দেখা নন। যেন এক আবিষ্কার। পরতে পরতে রহস্য। হাওড়ার অখ্যাত গলির যুবক যতই তাঁকে দেখেন, ততই দেখার নেশা বেড়ে যায়।

জল পায় মনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা বীজটা। ভ্রুণ জাগে ফুলের মতো। জন্ম নেয় ‘কত অজানারে’। প্রথম বই।

বইয়ের উৎসর্গ পত্রে লেখা, ‘নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েল মহোদয়ের পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশ্যে’...

 তথ্যঋণঃ (কত অজানারে-শংকর)

 

 

   

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...