অভিনয় জগতে এমন অনেক শিল্পী ছিলেন অথবা রয়েছেন, সমসাময়িক সময়ে যাঁদের উল্লেখ তুলনামূলকভাবে বড়ই ক্ষীণ, অথচ তাঁদের শিল্পীসত্ত্বা যেকোনও সময়েই আলোচনা যোগ্য। এখানে অবশ্য ‘পাবলিসিটি’র একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকেই থাকে। চিরাচরিত ভাবে এমনটাই হয়ে আসছে।
গীতা দে। তিনিও এইধরনের একজন শিল্পী, যিনি ‘পাবলিসিটি’ বোঝেন নি, বুঝেছেন শুধু নিজের কাজ। তাই ৫ আগস্ট, তাঁর জন্মদিনেও বড় ক্ষীণ, উপেক্ষিত তিনি। অথচ, ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা ছায়াছবি ও থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি।
থাকতেন কলকাতার দর্জি পাড়ায়। বাবা অনাদিবন্ধু মিত্র মেয়ের গান ও অভিনয়ের প্রতি প্রবল ঝোঁক দেখে তাকে প্রতিবেশী গায়িকা রাধারানী দেবীর কাছে তালিম নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। তাঁর কাছেই গীতার প্রথম জীবনের নাচ, গান, অভিনয় শিক্ষা। ১৯৩৭ সালে মাত্র ছ’বছর বয়সে তিনি ‘আহুতি’ নামে একটি বাংলা ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পান। ছবিটির পরিচালনায় ছিলেন ধীরেন গাঙ্গুলি, যিনি ‘ডি জি’ নামেই বহুল পরিচিত। এরপর তাঁকে দেখা যায় নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত ‘দম্পতি’ এবং সুকুমার দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘নন্দিতা’ তে।
ছোটবেলার এরকমই বেশ কিছু ছবি এবং মঞ্চে মাঝেমধ্যে অভিনয় করেছেন। তাঁর বয়স যখন পনেরো, সে সময় কলকাতার তালতলা নিবাসী ব্যবসায়ী অসীমকুমার দে’র সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের কয়েকবছর পর শিশির কুমার ভাদুড়ীর সংস্পর্শে আসেন তিনি। জীবদ্দশায় তিনি নিজে বলেছেন, ‘শিশির ভাদুড়ী ছিলেন আমার গুরু। অভিনেত্রী হিসেবে আমার সেরা গুণাবলীকে তিনি পূর্ণ রূপ দিয়েছিলেন।‘
থিয়েটারে কাজ করেছেন তুলসী লাহিড়ী, শম্ভু মিত্র, তুলসী চক্রবর্তী, জ্ঞানেশ মুখার্জি, কালী সরকার, কানু ব্যানার্জি, দিলীপ রায় প্রমুখের সঙ্গে। অভিনয় করেছেন কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে, স্টার থিয়েটারে। ‘অঘটন’ নাটকে অভিনয় করেছেন জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায়, অভিনয় করেছেন সমরেশ বসুর ‘বিবর’ নাটকে, পরিচালক ছিলেন রবি ঘোষ। ১৯৯৬ সালে উত্তর কলকাতার রঙ্গনা মঞ্চে শেষ অভিনয় করেন গণেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘বাদশাহী চাল’-এ।
১৯৫১ সালে নতুন করে বাংলা ছবিতে অভিনয়ের ডাক পান তিনি। প্রথমে উত্তম-সুচিত্রা খ্যাত ‘শিল্পী’, তারপর অগ্রদূত পরিচালিত ‘লালু ভুলু’, নির্মল দে পরিচালিত ‘বিয়ের খাতা’, ‘সাথীহারা’ –একের পর এক জনপ্রিয় ছবিতে শক্তিশালী চরিত্রাভিনেতা হিসেবে থেকেছেন তিনি।
জনপ্রিয় ছবিতে কাজ করতে করতেই ১৯৫৬ সালে তাঁর আলাপ হয় ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে। আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। ঋত্বিক পরিচালিত কালজয়ী ছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’(১৯৫৭), ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৫৯) এবং ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬০)-তে তাঁর উপস্থিতি সময়ের নিরিখে অমলিন।
অভিনয় করেছেন সত্যজিৎ রায়ে’র ‘তিনকন্যা’, ‘সমাপ্তি’-তে। তপন সিনহা’র ‘হাটেবাজারে’, ‘জতুগৃহ’, ‘এখনই’ –সবেতেই তাঁর নিজস্ব ছাপ রেখেছেন তিনি। এছাড়াও আরও অনেক বাংলা ছবিতেই উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি তাঁর।
এই যে তিনি এত বিপুল ছবি এবং থিয়েটারে অভিনয় করেছেন, ক’জন জানেন সে কথা! এ প্রজন্ম তো নয়ই, ও প্রজন্মেও তিনি যেন সার্বিকভাবে শুধুই ‘পার্শ্বচরিত্র’, ‘দজ্জাল মহিলা’, ‘বয়স্কা মহিলা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।
এখন যেমন ‘চরিত্রাভিনেতা’দের গুরুত্ব দেওয়ার একটা প্রবণতা তৈরী হয়েছে,তখন তো ‘চরিত্রাভিনেতা’-এই শব্দের আলাদা করে প্রয়োগ এবং প্রচলন কোনওটাই ছিল না। ব্যবহার হত ‘পার্শ্বচরিত্র’। সে সময় কোনও ‘লাইমলাইট’ই ছিল না, যা ‘পার্শ্বচরিত্র’-দের সেভাবে স্পর্শ করতে পারত। শুধু যাঁরা জহুরী তাঁরাই চিনে নিতেন পাকা সোনা, এমনটাই নিয়ম। তাই ‘স্টার’দের তালিকায় তাঁর নাম না থাকাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু অভিনয় জগতে তাঁর মত উজ্জ্বল নক্ষত্রের উপস্থিতি সদা উল্লেখযোগ্য।