বড় দুঃখের জানুয়ারী কাটাচ্ছে তিলোত্তমা। একে একে বিদায় নিচ্ছেন কৃতিরা। আজ প্রখ্যাত চিত্রকর ওয়াসিম কাপুর চলে গেলেন। বাংলা সমৃদ্ধ কৃষ্টি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তুলির টানে বাংলার ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলার ভান্ডারকে ঋদ্ধ করেছেন। সোমবার নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে, একঘণ্টার মধ্যে বাড়িতেই মৃত্যু চিত্রশিল্পীর, পড়ে রইল ক্যানভাস আর তুলি। লক্ষ্ণৌয়ে জন্ম হলেও তিলোত্তমা ছিল তাঁর কর্মভূমি। নিজের ছবির মাধ্যমে তুলির টানে মানুষের আবেগের কথা তিনি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতেন।
১৯৫১ সালের ৩রা জানুয়ারী লক্ষ্ণৌতে তাঁর জন্ম হয়েছিল। এরপর তাঁর শিক্ষা জীবন কেটেছে কলকাতায়। ১৯৭১ সালে কলকাতার ইন্ডিয়ান কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড ড্রাফটম্যানশিপ থেকে তিনি ফাইন আর্টসে সম্মানিক স্নাতক হন। কিন্তু রং-তুলি কীভাবে এসে পড়ল তাঁর জীবনে। ওয়াসিম তাঁর প্রথম জীবনের দীর্ঘকাল কাটিয়েছে হাসপাতালে, শৈশব-কৈশোরের চোদ্দ বছর চিকিৎসালয়ে অতিবাহিত হয়েছিল। তাঁর ভাই-বোন, বাবা, মা হাসাপাতালেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। ঐ হাসাপাতালে বেড শোয়া অবস্থায় ওয়াসিম চিত্রশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর বাবা এ জিনিস লক্ষ্য করেন এবং ছেলের জন্য একজন আঁকার শিক্ষক নিযুক্ত করলেন।
স্টেটসম্যানের বিজ্ঞাপন দেখে ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের অমর নন্দনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এই অমর নন্দই ওয়াসিমকে আঁকা শেখাতে আসতেন। হাসপাতালেই শুরু হল ছবি আঁকা শেখা। তিনিই কিশোর ওয়াসিমের সঙ্গে মাইকেল অ্যাঞ্জেল, নন্দলাল বসু, যামিনী রায় প্রমুখ শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় করলেন। ১২ বছর বয়সে তৈল চিত্র আঁকা শুরু করলেন, অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট সোসাইটি আয়োজিত প্রদর্শনীতে তাঁর ছবি মনোনীত হল। তাঁর চিত্রশিল্পী জীবনে প্রথম বড় সুযোগ এসেছিল প্রখ্যাত অভিনেতা ভিক্টর ব্যানার্জির হাত ধরে, আশির দশকে অ্যান্টি বার্ক সিরিজ আঁকতে শুরু করেছিলেন। ঐ সিরিজের একটি ছবি ছিল "ভিক্টিম"। এক মা আর তাঁর কন্যার ছবি। বিড়লা অ্যাকাডেমি যা উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। দেশ সেই ছবি দেশ পত্রিকার একটি সংখ্যার প্রচ্ছদ রূপে স্থান পেয়েছিল। সেই সূত্রেই ভিক্টর ব্যানার্জি ওয়াসিমের কাজ দেখেছিলেন এবং তাঁর বাড়িতে এসে প্রদর্শনীর জন্য একাধিক ছবি নিয়ে গিয়েছিলেন। তিলোত্তমার বুকে ১৯৬৯ সালে প্রথমবারের জন্য তাঁর একক চিত্রপ্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল। এছাড়াও দেশের নানান শহরে, প্যারিস, সুইডেন, জার্মানি, জাপান ইত্যাদির মতো পাশ্চাত্য দেশেও তাঁর আঁকা ছবি একাধিক প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে। দিল্লির ললিতকলা অ্যাকাডেমি, ন্যাশনাল গ্যালারী অফ মডার্ন আর্ট, বিড়লা অ্যাকাডেমি, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভবন, ইরান সোসাইটি, ভিক্টরিয়া মেমোরিয়াল-সহ দেশের বিভিন্ন সংগ্রহশালায় তাঁর আঁকা ছবি শোভা পাচ্ছে। জ্যোতি বসু-সহ বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ছবি এঁকেছিলেন তিনি।
কলকাতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছেন ওয়াসিম। প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের একটি বাড়িতে থাকতেন, আজ স্তব্ধ হয়ে গেলেন সেখানেই। দীর্ঘ শিল্পী জীবনে একাধিক সম্মানেও ভূষিত হয়েছেন ওয়াসিম কাপুর। ১৯৮০-৮১ সালে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস তাঁকে পুরস্কৃত করেছিল। ১৯৮৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে। এছাড়াও বিড়লা অ্যাকাডেমি এবং ১৯৮৫-তে এশিয়ান পেন্টস-এর তরফে শিরোমণি সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন ওয়াসিম কাপুর। তাঁর আঁকা চিত্র সারা ভারতের শিল্পীদের প্রশংসা আদায় করে নেয়।
বাংলার শিল্পীমহলে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়, দেশ তথা বিদেশের মাটিতেও তাঁর শিল্পকর্মের জনপ্রিয়তা ছিল। ভাবনা, উপস্থাপনা ও রঙের ব্যবহার তাঁর ছবিকে আলাদা মাত্রা দিয়েছিল। অবসাদ, যন্ত্রণা, একাকীত্বের মতো গভীর আবেগকে রং তুলির মাধ্যমে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন ওয়াসিম কাপুর। নিজের ক্যানভাসে আবেগ বরাবর হাতিয়ার করে গিয়েছেন তিনি। তাঁর অধিকাংশ ছবিতে নিমিলিত চোখে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠত। রং তুলির সহবাসে ক্যানভাসে ম্যাজিক তৈরি করতেন তিনি।
তাঁর নিজের কথাতেই উঠে এসেছে, নিমিলিত চোখ অনেক না বলা কথাকে ব্যক্তি করতে পারে। অনেক আবেগকে বর্ণনা করতে পারে। অপার নিস্তব্ধতারও তো ভাষা রয়েছে। তাঁর বয়, গার্ল, বারবণিতা ইত্যাদি সিরিজে ছবিগুলো ভারতীয় চিত্রকলার অনন্য সম্পদ। ছবি আঁকাকে মানুষের কথা বলতেই ব্যবহার করতেন তিনি। বাস্তবকে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং তারপর সেই বাস্তবের প্রতিফলন ঘটাতেন ক্যানভাসে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেন। প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠত ওয়াসিমের ক্যানভাস, নানা সময়ে নাগরিক জীবনের নানা সমস্যা নিয়ে মুখর হয়েছেন। ধর্মীয় গোড়ামির বিরুদ্ধেও একাধিকবার সরব হয়েছেন। নিজের রং, তুলির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো মানুষটি আজ চলে গেলেন। পড়ে রইল ফাঁকা ক্যানভাস।