সুনামির স্মৃতি ফিরে আসে প্রতি ছাব্বিশে

সেদিন আকাশটা মেঘলা। শীতের আমেজ আর কুয়াশায় মেঘলা আকাশ আলাদা করে চোখ টেনে নেয়নি কারুর। কিন্তু বাড়ির পাশের পুকুরের জল সেদিন আচমকায় কথা বলে উঠেছিল অন্যরকম ভাষায়। স্নানের ঘাটে সকালের ভিড়টা পাতলা হয়ে এসেছে, হঠাৎ যেন ঢেউ লাগল জলে। 

জলের তলা থেকে উঠে আসা এমন তোলপাড় আগে কখনও দেখেনি গাঁ ঘরের মানুষ। পুকুর থেকে পাড়ে ছিটকে আসছে মাছ। ছটফট করছে ডাঙায়। জলের পদ্ম শালুক সব ছিঁড়ে এলোমেলো। এমন চলল বেশ কিছুক্ষণ! তটস্থ মানুষ! কী হচ্ছে কেউ জানে না!

ঘরে এসে টিভি, রেডিয়ো চালু। পর্দায় ভয়াবহ সব ছবি। সমুদ্র থেকে উঠে আসা রাক্ষুসে ঢেউ তাড়া করেছে আর প্রাণ বাঁচানোর দৌড়ে মানুষ। নীল রঙের জল যে এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে ধারণা ছিল না মানুষের। আজ থেকে ঠিক আঠারো বছর আগে ভারতের বিপর্যয় ইতিহাসে পাকাপাকি ভাবে জুড়ে গিয়েছিল একটা শব্দ- ‘সুনামি’। তারিখটা ২০০৪। ২৬ ডিসেম্বর।

ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উপকূলে সমুদ্রগর্ভে সংঘটিত ভূমিকম্পের প্রভাবে  মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিশ্বের ১৪টি দেশ। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১,৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমান।  সমুদ্রগর্ভের ৩০ কিলোমিটার নিচে ছিল এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু৷ রিখটার স্কেলে ৯.৩ শক্তির জোরালো ভূকম্পন চলে প্রায় ৮-১০ মিনিট ধরে!

২০০৪ -এর ভারত মহাসাগরের এই সুনামি বক্সিং ডে সুনামি বা সুমাত্রা-আন্দামান ভূমিকম্প নামেও পরিচিত। রিপোর্ট অনুসারে, এর কম্পনগুলি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে পুরো বিশ্ব কেঁপে উঠেছিল এবং পৃথিবীর কোনও স্থান কম্পন থেকে রক্ষা পায়নি। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ছিল ইন্দোনেশিয়া।

সমুদ্র থেকে উঠে আসা ঢেউয়ের মাপ কোথাও কোথাও ৩০ মিটার ছুঁয়েছিল। ভারত, শ্রীলঙ্কা, মলদ্বীপ, থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়ার ২৩০,০০০-এরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। গোটা বিশ্বে দু’লক্ষেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। ভারতে সেই সংখ্যাটা ছিল ১০,১৩৬ জন। বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তামিলনাড়ু রাজ্যের উপকূলবর্তী এলাকা। আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে কেবল নিকোবর দ্বীপেই মারা গিয়েছিল শত শত মানুষ। ভেসে গিয়েছিল জান-জীবন। বিপর্যস্ত মানুষের মুখ, ধ্বংসের ভয়াবহতা দেখে শিউরে উঠেছিল মানুষ।

ক্রিস মাস আর বছর শেষের ছুটি কাটাতে পর্যৎক ভিড় ঠিকঠিক করছিল সমুদ্র তীরের পর্যটন কেন্দ্র আর রিসোর্টগুলোতে। সমুদ্রের তীরে অনেক মানুষ। হঠাৎ পিছু হঠতে শুরু করে জল। তারপরই আছড়ে পড়ে ঘাতক ঢেউ।

সমুদ্রে জলের স্তর যে নামতে শুরু করেছে সেই দৃশ্য দেখেছিল আন্দামানের জারোয়ারা। জাপানী লোককথা বলে জলের দৈত্য জেগে ওঠার আগে জল এমন নেমে যায়। জারোয়া প্রজাতির মানুষ সরে গিয়েছিল জলের এমন নেমে যাওয়া দেখে। সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে থেকে সরে গিয়েছিল পশুপাখীরাও। 

প্রলয় থেকে মানুষের কথা আর জীবন বাঁচানোর লড়াইকে কুর্নিশ করেছিল গোটা বিশ্ব। তেমনি কাহিনি জ্যোতিপ্রিয়ার।

ভি বাসুদেব সরকারি কর্মী। দুই মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে নিয়ে ২৬-এর সকালে গিয়েছিলেন মন্দিরে পুজো দিতে।

হঠাৎ প্রচন্ড ভূমিকম্প। পরিবার নিয়ে জঙ্গলের দিকে ছুটেছিলেন ভি বাসুদেব। তাঁর হাতে ধরা বড় মেয়ের হাত। স্ত্রীয়ের কাছে ছোট কন্যা।

সুনামি দু’ নম্বর ঢেউ আছড়ে পড়তে বাসুদেব দেখলেন জলের ধাক্কায় স্ত্রীর হাত থেকে ভেসে গেল মেয়েটা। ঢেউ সরে জায়গাটায় যেতে শুধু বালি। তারপরই তৃতীয় ঢেউ। ভেসে গিয়েছিল স্ত্রী।

সুনামিতে ভেসে গিয়েছে অসংখ্য জীবন। মানুষ ভুলতে পারেনি তাঁদের। বিপর্যয়ে ভারতের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্থ তামিলনাড়ুতে প্রতি ডিসেম্বর সুনামিতে অকালপ্রয়াত মানুষদের স্মরণ করে সেখানকার মৎসজীবী মানুষ। সমুদ্রের তীর ধরে মৌন মিছিল করেন তাঁরা। জলে নিবেদন করেন দুধ আর চোখের জল। মোমবাতি আর ফুলে স্মরণ করা হয় স্মৃতি হয়ে যাওয়া মানুষদের।    

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...