একটা মুহূর্ত। সহজেই ভুলে যাওয়া যায়। এই ক্ষুদ্র একটা মুহুর্তের ইতিহাস হয়ে থাকার সাধ্য নেই। ফাইনাল ম্যাচে চেলসিকে হারিয়ে ২০০৮ ইউরোপ সেরার তকমাটা তো এর চেয়ে অনেক গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কালের সাক্ষীও হয়ে থাকবে ওই দল আর ট্রফিটা। সাথে আলাদা করে একজন। ওই মুহুর্তটা যিনি নিজের করে নিয়েছিলেন।
তিনি এডউইন ভ্যান ডার সার। "দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান" এই নামে যাকে আগে চিনত সবাই। ইংলিশ ফুটবল ইতিহাস এর সর্বকালের অন্যতম সেরা গোলকিপারদেরও ছোট্ট তালিকায় অনিবার্যভাবে যার নাম থাকে অনেক উপরে। স্যার ফার্গুসনের মতে, পিটার স্মাইকেলের পর তিনিই ম্যান ইউনাইটেডের সর্বকালের সেরা গোলকিপার।
২১শে মে ২০০৮, রাশিয়া। ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের অল ইংলিশ ফাইনালে মুখোমুখি ইংল্যান্ডের অন্যতম প্রভাবশালী ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং চেলসি। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে উপস্থিত প্রায় ৬৯,৩১০ ফুটবলপ্রেমী। আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণে পুরো মস্কোয় ছেয়ে গেছে লাল-নীলের সমারোহে। নির্ধারিত সময়ের ৯০ মিনিটে, ১-১ ড্র! বহুকাঙ্ক্ষিত ফার্গি টাইমও শেষ! ফলাফল পেনাল্টি শুটআউট! স্পট কিকে শুরুতেই চাপে স্যার ফার্গুসনের শিষ্যরা। দলের হয়ে পেনাল্টিতে গোল করতে ব্যর্থ দলের সেরা খেলোয়াড় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। টুর্নামেন্ট জুড়ে অসাধারণ খেলেও রোনালদোর পেনাল্টি মিসে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায় ফার্গুসনের কপালে!
পঞ্চম শটে ব্লুজদের হয়ে জন টেরি পেনাল্টি মিস করলে খেলা গড়ায় আবারও সমতায়। ষষ্ঠ শটে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও চেলসি উভয়ে গোল করে। শেষ পেনাল্টি সফল গোল করে গিগস। এবার চেলসির হয়ে পেনাল্টি নিতে আসেন ফরাসি কিংবদন্তী নিকোলাস আনেলকা। ডু অর ডাই সিচ্যুয়েশন। গোল মিস হলেই চ্যাম্পিয়নস লীগের সোনালি ট্রফি চলে আসবে থিয়েটার অব ড্রিম ওল্ড ট্রাফোর্ডে।
নিকোলাস এসে নিলেন ডান পায়ে এক জোরালো শট, সাথে সাথে ডাইভ দিলেন ম্যানচেস্টারের মহাপ্রাচীর এডউইন ভ্যান ডার সার! এবং গোল সেভ! আনেলকার চেহারা তখন বিস্ময়ে হতবিহ্বল। টিভিতে ধারাভাষ্যকার বলতে থাকল, "Edwin van der Sar saved Manchester United again! "Edwin van der Sar saved Manchester United again!"
চ্যাম্পিয়নস লীগ এল ওল্ড ট্রাফোর্ডে। আর এ জয়ের মহানায়ক একজনই। তিনিই ম্যাচ সেরা এডউইন ভ্যান ডার সার। জন্মের আগেই বোধহয় খেলোয়াড় হওয়ারই নিয়তি লেখা ছিল যার কপালে! ১৯৭০ সালে হল্যান্ডে জন্ম সারের। ক্যারিয়ার শুরুটা করেন নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত স্থানীয় ক্লাব ফোরহেটে। তার পর চলে যান নর্দউয়িজক দলে। সেখানেই নজরে পড়েন ততকালীন আয়ক্স কোচ ফন গালের। ১৯৯০ সালে আয়ক্সে যোগ দেন। আয়ক্সের হয়ে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সময়ও কাটান। প্রথম মৌসুমেই জিতেন উয়েফা কাপ।
মাত্র দু'মৌসুম পর হয়ে যান ক্লাবে প্রথম পছন্দের গোলকিপার। শুরু হয় ক্যারিয়ারের নতুন অধ্যায়ের। আয়ক্সের প্রথম গোলকিপার হয়ে শুরুর মরশুমেই জিতে নেন ডাচ গোলকিপার অব দ্য ইয়ারের পুরস্কার। ডাচ বর্ষসেরার গোলকিপার প্রায় নিজের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলছিলেন ভ্যান ডার সার। ইতিহাসের প্রথম গোলকিপার হিসেবে জিতেছেন টানা তিনবার ডাচ বর্ষসেরা গোলকিপারের পুরস্কার। এই সময়ে ডাচ ক্লাবটির হয়ে ২২৬ ম্যাচ খেলে ক্লিনশীট রাখেন ৯৮টি। আয়ক্সের হয়ে ৪টি লীগ, একটি চ্যাম্পিয়নস লীগ, ৬টি ডোমেস্টিক কাপ, উয়েফা সুপার কাপ, উয়েফা কাপ এবং বিশ্বকাপ-সহ সব শিরোপা জিতে নেন।
ভ্যান ডার সার যখন ডাচ লীগে রাজ করছেন ফার্গুসন তখন ইউনাইটেড দলে পিটার স্মাইকেলের রিপ্লেসমেন্ট খুঁজছেন। ফার্গুসন সারকে ওল্ড ট্রাফোর্ডে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু, সার যোগ দেন ইতালির তুরিনো বুড়িদের জুভেন্টাসে। ওল্ড লেডিদের হয়ে প্রথম দু'মরশুম ফার্স্ট চয়েস গোলকিপার হলেও জিয়ানলুজি বুফনের আগমনে দলে জায়গা হারান। ফলে জুভেন্টাস ছাড়াও ভ্যান ডার সারের জন্য প্রায় অনিবার্য হয়ে পড়ে। হ্যাঁ, দুই মরশুমের পর ডার সার ঠিকই জুভেন্টাস ছাড়েন। আর এই সময়ে ডন কার্লো আনসেলত্তির জুভেন্টাসের হয়ে ম্যাচ খেলে যান ৬৬টি। এলেন ইংল্যান্ডে; যোগ দেন নবাগত ফুলহ্যামে। জুভেন্টাসের ব্যাকফুটে থাকা সার ফুলহ্যামে যোগ দিয়েই নিজের স্বস্তির কথা জানান দেন।
২০০১ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে ডেব্যু হয় ভ্যান ডার সারের। ফুলহ্যামের হয়ে ৫ মৌসুমে মোট ১৩৭টি লীগ ম্যাচ খেলেন। ২০০৫ সালে অ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ম্যাচটি খেলেন। সেই ম্যাচে তার পরপর দারুণ দুটো পেনাল্টি সেভে ফুলহ্যাম হারা ম্যাচও জয় নিয়ে মাঠে ছাড়ে। ফলে আবারও নজর কাড়ে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের। ফার্গুসন সারকে দলে ভেড়ানোর জন্য ইউনাইটেড ম্যানেজমেন্টকে চাপ দেন। ১০ জুন ২০০৫, ২ মিলিয়ন পাউন্ড চুক্তিতে রেড ডেভিলদের দলে যোগ দেন ভ্যান ডার সার। ইউনাইটেডে যোগ দিয়ে আবারও নিজের জাত চেনান। প্রথম ম্যানচেস্টার ডার্বি ম্যাচেই দারিইয়ুস ভাসেলের পেনাল্টি দারুণভাবে সেভ করে দলের পূর্ণ তিন পয়েন্ট নিশ্চিত করেন।
অন্যদিকে চেলসিও এমিরাত স্টোডিয়ামে গিয়ে আর্সেনালের সাথে হেরে গেলে নিশ্চিত হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নবম প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা। নিজে জায়গা করে নেন PFA Team Of The Year এর তালিকায়। তার তিন মাস পর টানা তিনটি পেনাল্টি সেভ করে আবারও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে শিরোপা জেতান। এবার জেতেন এফএ কমিউনিটি শিল্ড কাপ। পরের মরশুমটি ছিল সারের ক্যারিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ বছর।
মরশুমে জুড়ে অসাধারণ পারফরম্যান্স করে জিতে নেন ব্যাক টু ব্যাক প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা। মস্কোতে মহাকাব্যিক পেনাল্টি শুট-আউটে লেজেন্ডারি নিকোলাস আনেলকার ক্ষীপ্র গতির শট থামিয়ে দিয়ে ম্যান ইউনাইটেডকে এনে দেন ইউরোপ শ্রেষ্ঠর মুকুট। খেলা শেষে ফার্গুসন বলেন, "Edwin is the best goalkeeper we have had since Peter Schmeichel. He is a winner. He has brought with him a strength of character; he really looks after himself and he trains very well. His professionalism and dedication to his job and the way he looks after himself has given him longevity in the game."
ডার সার ইউনাইটেডে এসেছিলেন পিটার স্মাইকেলের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে। ডার সার তা দারুণভাবেই কাজে লাগিয়েছেন। স্যার ফার্গুসনের দলে যেমন স্মাইকেলের গুরুত্বপূর্ণ ছিল; তার রিপ্লেসমেন্টে এসে ভান ডার সারও নিজের গুরুত্ব বুঝিয়েছিলেন। নিজেকে বানিয়েছিলেন স্যার ফার্গুসনের দলের অবিচ্ছেদ্য অংশও। ৬ মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে খেলেছিলেন ২৬৬ ম্যাচ ও ক্লিনশিট রাখেন ১২৯ ম্যাচ। ম্যান ইউনাইটেডের হয়ে জিতেছেন ৪টি প্রিমিয়ার লিগ, ৩টি ডোমেস্টিক কাপ, ১টি চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং একটি ক্লাব বিশ্বকাপ। ডার সার ইতিহাসের একমাত্র গোলকিপার যিনি দুটি ভিন্ন ক্লাবের হয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জতেছেন।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে সর্বাধিক এক টানা ম্যাচের ক্লিনশিট রাখার রেকর্ডটি এখনও তার দখলে। ২০০৭-০৮ মরসুমে চেলসির পিটার চেকের (১০) ক্লিনশিট রেকর্ডটি ব্রেক করে সর্বাধিক টানা ১১টি ম্যাচ কিংবা সময়ের হিসেবে ১,৩১১ মিনিট কোন গোল হজম না করার এই রেকর্ড গড়েন। চ্যাম্পিয়নস লীগ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সে ফাইনাল ম্যাচ খেলা গোলকিপার এখনও তিনি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ইতিহাসে তার অবদানের কথা স্বীকার করে গ্রেটেস্ট পিটার স্মাইকেল বলেন, "Someone I always admired, even early in his career at Ajax and Juventus. In six years at Old Trafford, he helped Manchester United to three Champions League finals, and gave them great stability from the back.”
এডউইন ভ্যান ডার সার ছিলেন কমপ্লিট গোলকিপার। আয়ক্সে থাকাকালীন তার বক্স কন্ট্রোল, ডাইভিং সেভ, বল প্লেয়িং, দারুণ পজিশন সেন্স, রিপ্লেক্সেস, স্ল্যান্ডারি ও লিবারো রোল মোটামুটি 'সুইপার' গোলকিপারের মত লাস্ট ডিফেন্ডার হয়ে দলে এক্সট্রা প্লেয়ারের বেনিফিটও দিত। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের গোল বারের নীচে তার উপস্থিতি দলের ডিফেন্ডারদের জন্যও এক্সট্রা বেনিফিট ছিল; দলের এট্যাকিং বিল্ডআপেও তারা সাহায্যে করতে পারত।
জাতীয় দলের হয়ে কিছু জিততে না পারলেও ক্লাব ফুটবল কিংবা আন্তর্জাতিক ফুটবলে তার বিশাল নিছক মুছে যাওয়ার মত না। ইউনাইটেডের ইতিহাসে ডার সার এক অনন্য নাম, সেরাদের সেরা একজনও। তাই স্যার ববি চার্লটন বলেছেন, "He is not a normal keeper. The players in front of him always can have the thought: we still have Edwin. He has got so much talent and a strong character. Maybe he is the best goalkeeper United ever had, but we also had Schmeichel. But Van der Sar is unique.”