তমসো মা জ্যোর্তিগময়। অজ্ঞানতার আঁধার সরিয়ে জ্ঞানের আলোক বর্তিকা জ্বলে উঠুক। প্রদীপের আলোক শিখায় সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাশ হয়ে সূচনা হোক শুভর।
দেবতার সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে তমসাকে দূর করে শুভ শক্তির আরাধনা করা হয়। শুধু পুজো নয়, হিন্দুদের সমস্ত ধরণের অনুষ্ঠান, বিবাহ বা যেকোন মঙ্গল কামনায় প্রদীপ জ্বালিয়ে কাজের শুভারম্ভ করা প্রচলিত রীতি।
মধ্য প্রস্তর যুগে প্রদীপ অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সেই প্রদীপ ছিল পাথরের তৈরি। ১৯৪০ সালে লাস্কাস থেকে সেই প্রদীপ মেলে। তবে অনেক গবেষক অবশ্য মনে করেন, প্রদীপের ইতিহাস অত প্রাচীন নয়। তাঁদের মতে প্রদীপের ইতিহাস ছয় হাজারের বেশি পুরনো হবে না।
ব্রোঞ্জ যুগেও প্রদীপের ব্যবহার বহুল পরিমাণে পাওয়া গিয়েছে। এইসময়ে চার সলতে যুক্ত প্রদীপ বেশি দেখা যেত। তার আকার বড়ো বাটির মতো।
বৈদিক যুগে প্রতি বাড়িতে প্রদীপ জ্বলত। প্রদীপ দিয়ে বাড়ি সাজিয়ে রাখার রেওয়াজ ছিল। ধীরে ধীরে তা দেব-দেবীর মূর্তির সামনে, বা বলা ভালো পুজোর প্রতীকীরূপ হয়ে ওঠে।
সব রকম ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রদীপ অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে যায়। এই সময় দীপদানকে শ্রেষ্ঠ দান মনে করা হত। রামায়ণ ও মহাভারতে সোনা ও রুপোর প্রদীপের চল ছিল।
শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতায় প্রদীপের ব্যবহার ছিল।
উত্তর ভারতে চারটি সলতে বিশিষ্ট প্রদীপের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। তেলের থেকে ঘি দেওয়ার চল বেশি।
দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন ধরণের প্রদীপ দেখা যায়। যেমন "দীপলক্ষ্মী", "নীলাভিলক্কু", "পাভাই ভিলাক্কু", "থুকু ভিলাক্কু", "নাচিয়ারকোলি" বিভিন্ন নামের এবং আকৃতির প্রদীপ আছে।
দুর্গাপুজোয় প্রদীপের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ষষ্ঠীর দিন বোধনের সঙ্গে সঙ্গে রেড়ি তেল বা ঘি দিয়ে গাছ প্রদীপ জ্বালানো হয়। গাছ প্রদীপ নিভে যাওয়ার অর্থ অশুভ।
জাগ প্রদীপ জ্বালানোর অর্থ দেবী বা দেবতা সেখানে অধিষ্ঠান করছেন। দুর্গা পুজোয় ষষ্ঠীতে বোধনের দিন জাগ প্রার্দীপ জ্বালানো হয় আর দেবীর বিসর্জনের সঙ্গে তা নিভে যায়। সন্ধিপুজোয় জ্বালানো হয় ১০৮ টি প্রদীপ। হিন্দু শাস্ত্র মতে ১০৮ শুভ। তাই ১০৮ টি পদ্মের সঙ্গে ১০৮ টি প্রদীপ জ্বালানো রীতি।
মৃৎশিল্পীরা প্রদীপ তৈরি করেন প্রদীপের ছাঁচের সাহায্যে। সলতে রাখার অংশটি এবং তেল রাখার অংশটি আঙুলের সাহায্যে তৈরি করা হয়। তারপর রোদে শুকিয়ে পুড়িয়ে নেওয়া হয়। পোড়ানো হয়ে গেলে রং করা হয়।
গতবছর থেকে একধরণের প্রাকৃতিক প্রদীপ বাজারে এসেছে। সেটি রোদে শুকানোর পর পোড়ানো হয় না এবং ভেষজ রং করা হয়। প্রদীপের তলায় গাছের বীজ রাখা থাকে। প্রদীপের কাজ শেষ হয়ে গেলে টবে বা মাটিতে রেখে দিলে সেখান থেকে নতুন চারা গাছ জন্মায়। সেই সঙ্গে এই গাছ প্রদীপ পরিবেশ বান্ধবও। জলে ফেলা হলেও জলদূষণ হবে না।
তবে বর্তমানে টুনি লাইট বা প্লাস্টিকের প্রদীপ বাজারে আসায় মৃৎশিল্পীদের ভীষণ রকমের প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সেগুলো দামে সস্তা হওয়ায় তার চাহিদাও বেশি বলে মনে করছেন মৃৎশিল্পীরা।
দীপাবলিতে প্রদীপের জায়গায় টুনি বাল্বের চাহিদা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। মৃৎশিল্পীরা দুর্গাপুজো ও দীপাবলির অপেক্ষায় থাকেন। অনেকে আবার এই জীবিকার বদলও ঘটাচ্ছেন।
"নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু" জন্ম হোক বা উৎসব বা পুজো-পার্বণ, হিন্দুদের সমস্ত শুভ কাজে প্রদীপ থাকবেই।
মৃত্যুর পরও প্রদীপ জ্বালিয়ে পূর্ব পুরুষের তর্পন করা হয়। তাই হিন্দু শাস্ত্রে প্রদীপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।