অসমের কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যান। বিখ্যাত ‘গ্রেটার ওয়ান হর্ন রাইনো’ বা এক শৃঙ্গী গণ্ডারের জন্য। এই শৃঙ্গের কারনেই বিপদে পড়ে ইন্ডিয়ান রাইনো প্রজাতির গণ্ডাররা। চোরা শিকারীদের শ্যেন নজর সব সময় থাকে তাদের ওপর। আর সেটাই এই প্রজাতির বিপন্নতার সবচেয়ে বড় কারণ।
বন রক্ষকের দায়িত্ব যারা পালন করেন তাদের বিপদও কম নয়। অনেক সময় চোরাশিকারিদের ট্রিগারের লক্ষ্য হন তাঁরা। পদে পদে বিপদ নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। এক্ষেত্রে বিপদ বনের পশু নয়, মানুষ।
৫৩ বছরের দিম্বেশ্বর দাস এই কাজটাই করে চলেছেন প্রতিদিন। গত তিরিশ বছর ধরে। কাজিরাঙা অবশ্য তাঁকে চেনে ‘দিম্ব’ নামে।
১৯৮৭ সালে কাজিরাঙায় নৌচালক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানের বনরক্ষীর পদে।
অসম বন দফতরের একজন নীরব কিন্তু দায়িত্বপূর্ণ কর্মী। কাজিরাঙার সংরক্ষিত অঞ্চলকে সুরক্ষিত রাখতে তিনি সামনে দাঁড়িয়ে কাজ করেন। বলা যায় প্রায় যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে দিম্বেশ্বরের কাজ। সেই কাজ করতে গিয়ে বহুবার জীবন বিপন্ন হয়েছে। তবু পিছিয়ে আসেননি। তিন দশক ধরে একইভাবে বন্যপ্রাণ রক্ষা করে আসছেন।
তিনি এবছর ‘আরবিএস আর্থ হিরোজ অ্যাওয়ার্ড-২০১৯’ সম্মান পেলেন। এই সম্মান এসেছে স্কটল্যান্ড থেকে। রয়্যাল ব্যাঙ্ক স্কটল্যান্ডের ‘গ্রিন ওয়ারিয়্যর’ বিভাগে স্বীকৃতি পেয়েছেন। অনেকের মতেই দিম্ব এমনভাবে তাঁর কাজ করেন যা যে কোন দেশের মানুষের কাছে উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়ে স্বভাবতই খুশি দিম্বেশ্বর জানিয়েছেন, ‘আমি আমার কাজকে কখনও কাজ হিসেবে দেখিনি। অরণ্য আমার জীবন। শুধুমাত্র পেটের দায়ে কাজ করিনা। দায়টা প্রাণের। ’
জাতীয় উদ্যানে কাজ করতে গিয়ে দিম্বেশ্বর বেশ কয়েকবার চোরাশিকারীদের বুলেটের শিকার হয়েছেন। তাঁর অনেক ক্ষেত্রে বন্য পশুদের হামলার মুখেও পড়েছেন। হুমকি তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে মাঝে মাঝে তার তীব্রতা এতটাই যে সপরিবারে নিজের বসত বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র বাসা খুঁজে নিতে হয়েছে।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘২০১২ সালে আমি প্রথমাবার পাচারকারীদের আক্রমণের মুখে পড়েছিলাম। বনের পশুদের থেকে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ছিল তারা। যদি তাদের পথে তুমি বাধা হয়ে দাঁড়াও সঙ্গে সঙ্গে শেষ করে দেবে। কোনোরকমে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছিলাম। তারপর থেকে পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে ভয়ে থাকি। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ে থাকি বন্যপ্রাণীদের নিয়ে।’
প্রবীণ এই মানুষটির কথায় কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানের রক্ষকের ভূমিকা পালন করা পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক কাজ। চ্যালেঞ্জেরও বটে। একদিকে হিংস্র চোরাশিকারী অন্যদিকে হিংস্র পশু। দুপক্ষই আক্রমণ করতে পারে যে কোন মূহুর্ত। অনেকেই দেখেছেন কাজ করতে গিয়ে বাঘের কবলে পড়তে। তিনি নিজে বহু সময় উদ্ধার করেছেন সহকর্মীদের। ফরেস্ট সাফারির সময়ও এসেছে অতর্কিত আক্রমণ।
দিম্বেশ্বর তিন দশক পার করে এসেছেন চাকরি জীবনের। তাঁর সহকর্মীরা অনেকেই বিপদ আর ঝুঁকির মাত্রা দেখে কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছে। তিনি অটল থেকেছেন নিজের সিদ্ধান্তে। ছেড়ে যাননি। ভয় নিয়ে থাকতে থাকতে একসময় বোধহয় ভালবেসে ফেলেছেন ভয়টাকে। সঙ্গে এই বন আর তার আশ্রয়ে থাকা প্রাণগুলোকে। তারই স্বীকৃতি পেলেন এই ভূমিপুত্র সবুজ যোদ্ধার সম্মানে।