আঁকড়ে ধরি, এ 'ধরা'-কে

 

'বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ', 'প্রকৃতির সুফল-কুফল' -এসব একঘেঁয়ে, ঘ্যানঘ্যানে বিষয় ধারাবাহিকভাবে 'মুখস্থ' করতে গিয়ে তা 'আত্মস্থ' করার ব্যপারটা এখন ডুমুরের ফুলের মতই হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রবাদে আছে অস্তিত্বে নেই। কিন্তু ব্যপারটাকে যতই গরুর রচনার মত 'কমন' বা এলেবেলে মনে হোক, টিকে থাকা টিকিয়ে রাখার দায় টা কিন্তু 'প্রকৃতি'গতই, পাত্তা না দিলে উপায়ও থাকবেনা। তাই বিশ্বের প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা ও ভালোবাসা সৃষ্টির তাগিদে প্রতি বছর ২২ এপ্রিল-তারিখটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে বিশ্ব ধরিত্রী দিবস’ বা 'World Earth Day' পালনের উদ্দেশ্যে।

জন্মের সঙ্গে যেমন গাঁটছড়া বাঁধা থাকে মৃত্যু'র,  তেমনই সৃষ্টির সঙ্গে বাঁধা থাকে ধ্বংস,  চিরাচরিত এবং অবধারিত। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও যেমন মানুষ বেঁচে থাকার গান বাঁধে, তেমনভাবে ধ্বংস অনিবার্য জেনেও আমাদেরকে প্রশস্ত এবং সংরক্ষিত করতে হবে সৃষ্টির পথ। অনুমান করা হয়,  ইন্দাস নদীর গতিপথের পরিবর্তন, পাশাপাশি সরস্বতী বা ঘাগর-হাকরা নদীর জল শুকিয়ে যাওয়াই মহেঞ্জোদাড়োর অবক্ষয়ের মূল কারন। প্রায় ৩০ হাজার মানুষের জনবসতির অবসান ঘটেছিল। আমরা যেভাবে প্রকৃতির দূষণ সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্বেও উপযুক্ত সচেতনতাকে এখনও এড়িয়ে চলছি এবং বাধ্য হয়ে জড়িয়ে নিচ্ছি প্রযুক্তি-চাদর, তাতে আগামীতে আমরা ধরিত্রীকে কিভাবে সংরক্ষন করব অথবা আসন্ন ‘অবসান’কে কিভাবে প্রতিহত করব, তা বিরাট প্রশ্নের মুখে।

বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্রমে ক্রমে মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে,  এই ভাবনা থেকে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে মার্কিন সিনেটর গেলর্ড নেলসন (Senator Gaylord Nelson) এই বিষয়টি নিয়ে ভাবা শুরু করেন। ইনি ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে এ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডির (Attorney General Robert Kennedy) কাছে এই বিষয়টি নিয়ে আলাপ করার জন্য ওয়াশিংটন যান। প্রথম দিকে বিষয়টিকে বেশিরভাগ মানুষ ততটা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি। ক্রমে ক্রমে এই বিষয়টি বহু মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করে তোলে অবশেষে তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সাধারণ মানুষ এবং সরকারি মহলে বিশেষ গুরুত্ব আদায় করে নিতে তিনি সফল হন। এই সূত্রে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে ধরিত্রী দিবস’ পালনের দিন হিসাবে ২২ এপ্রিল নির্ধারণ করা হয়। এখন পৃথিবীর অনেক দেশেই সরকারিভাবে এই দিবসটি পালন করা হয়। ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিকভাবে ১৪১টি জাতির দ্বারা আয়োজন করা হয়েছিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবস।

১৯৭০ সালে এই পরিবেশ আন্দোলনের নাম দেওয়া হয়েছিল এনভায়রনমেন্টাল টিচ-ইন’ ওই বছর আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো সিটিতে প্রথম ধরিত্রী দিবস পালিত হয়। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ তাদের বাৎসরিক পঞ্জিকায় দিবসটিকে স্থান দেয় এবং জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহে তা প্রতিপালনের জন্য উৎসাহ প্রদান করা শুরু করে। ফলে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই দিবসটি ‘বিশ্ব ধরিত্রী দিবস’ নামে আন্তর্জাতিক ভাবে পালিত হচ্ছে।

ধরিত্রী দিবস উদযাপনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন ও উৎসাহী করে তোলা। পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় জাতিগতভাবে, গোষ্ঠীগতভাবে অথবা ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমাদের প্রত্যেকের অংশগ্রহণ জরুরি হয়ে উঠেছে। মানুষের সার্বিক সচেতনতার জন্যে মানুষকে আরও আরও সচেতনতা বাড়াতে হবে বিজ্ঞান বিষয়ে, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে, ভোগবিলাসী মানসিকতার বিপক্ষে। কিন্তু শুধু ভারত নয় বিভিন্ন প্রদেশেই রয়েছে পর্যাপ্ত-সঠিক শিক্ষার ঘাটতি, যার প্রভাবে একবিংশ শতাব্দীতেও বৃদ্ধি পাচ্ছে অসচেতন, বিজ্ঞানবিরোধী মানসিকতা। ডায়নোসররা পৃথিবীতে নিজেদের অস্তিত্ব কায়েম রেখেছিল প্রায় ২৪ কোটি বছর। তারপর প্রকৃতির দুর্বিপাকে তারাও বিলুপ্ত হয়েছে, এ আমাদের জানা। সেখানে মানবজাতির উদ্ভব কয়েক লক্ষ বছর আগে। মানবকূল যেভাবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে নিজেদের জীবন-যাপনের সুবিধার্থে, ভোগবিলাসের আধিক্যে, বিলাসিতার ভ্রমে প্রকৃতির যথেচ্ছ অপচয়, অসদাচরণে নিজেদের সীমালঙ্ঘনের পুনরাবৃত্তি করে চলেছে তাতে মানুষ নিজেকে গণবিলুপ্তির মুখে দাঁড় করাচ্ছে। আমরা যে প্রকৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, আমরা যে একে অপরের পরিপূরক তা ডাহা ভুলে যাই। যত আঘাত প্রকৃতিকে করা, ততটাই নিজেদের প্রতি। যতক্ষণ না একটা ভুমিকম্প আমাদেরকে পিশে ফেলছে, যতক্ষণ না একটা সুনামী তার সর্বগ্রাসী হাঁ-এ আমাদের গিলে ফেলছে, যতক্ষণ না খরায় আমরা শুকিয়ে যাবো,  যতক্ষণ না বন্যায় ভেসে যাব, যতক্ষন না একটা ধ্বসে জনবসতি নিশ্চিহ্ন হচ্ছে, যতক্ষণ না সজোরে ধাক্কা লেগে দেওয়ালে পিঠটা ঠেকে যাবে, আর্তনাদ ভেসে বেড়াবে জনজীবনে, ঠিক ততক্ষণ আমরা ভুলে থাকব প্রকৃতি কি চাইছে, পরিবেশ কি বলছে,  বুঝবনা অবলা পশু-পাখীদের আর্তি। শুধু মনে রেখে দেব বিষয়-আশয়, লোভ-লালসা, ভুল-ভ্রান্তি, অযুত-নিযুত, খাদ্য-খাদক , একেবারে অক্ষরে অক্ষরে। যত উন্নয়ন, যত উন্নতি, তত সংকট, তত তলিয়ে যাওয়া। তবে আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই, এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে আমাদের হাত-পা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। তবু আমাদের মনে রাখতেই হবে, শুধু 'প্রোগ্রেসিভ' বাঁচার তাগিদে নয়, নিজেরদের জীবন যাপন ও অস্তিত্ব রক্ষার কুৎসিত দর্শনগুলোকে বাদ দিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা ও বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে আরও গভীর মূল্যবোধের ক্ষেত্র আমাদেরকেই নির্মান করতে হবে

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...