সময়টা আশির দশক। কলকাতায় ফটোগ্রাফির স্টুডিয়ো গুলোতে ফটোগ্রাফাররা বেশিরভাগই ইংরেজ। সেখানে ছবি তুলতে আসতেন বাঙালি মহিলারা। অধিকাংশই ধনী বাড়ির। পুরো পালকিটাই ঢাকা। তাঁদের সঙ্গে থাকত দাসী। স্টুডিয়োতে সেই সময় পুরুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। আগে থেকেই ক্যামেরা, লেন্স ফটোগ্রাফার তৈরি থাকত। তাঁরা স্টুডিয়োতে ঢুকলেই ক্যামেরা কথা বলে উঠত। ছবি তোলার কাজ শেষ হলেই নিমেষের মধ্যে পালকির দরজা বন্ধ। যেভাবে আসতেন ওঁরা সেভাবেই উধাও হয়ে যেতেন।
এই অবস্থা কিছুটা বদলালো ১৮৫৭ তে। বদলালেন মিসেস মেয়ার। এক ইংরেজ মহিলা। ফটোগ্রাফির চর্চা করতেন। ৭ নম্বর ওল্ড কোর্ট স্ট্রিট হাউসে তিনি একটি স্টুডিয়ো শুরু করলেন।
কয়েক বছর পর সেই স্টুডিয়ো ওয়াটারলু স্ট্রিটে সরে যায়। কলকাতা শহরে পুরুষ ফটোগ্রাফারদের ভিড়ে মেয়ারের ‘জেনানা স্টুডিয়ো’ প্রায় বিপ্লব ঘটিয়েছিল বলা যায়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু এই শহরে মহিলাদের ফটোগ্রাফির চর্চা বন্ধ হল না। বাড়ির অন্তরমহলে পর্দার আড়ালে একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরের ফটোগ্রাফি চর্চা অচিরেই প্রকাশ্যে এল।
শোনা গেল সরোজিনী ঘোষের নাম। প্রথম বাঙ্গালি মহিলা যিনি স্টুডিয়ো স্থাপন করে ফটোগ্রাফির চর্চা শুরু করেন। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনও প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর স্টুডিয়োর। স্টুডিয়োর নামের মধ্যে উল্লেখ ছিল ‘ মহিলা’ শব্দটি। নাম রাখা হয়েছিল ‘ দ্য মহিলা আর্ট স্টুডিয়ো অ্যান্ড আর্ট সেন্টার’। ঠিকানা ৩২ নম্বর কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট। এই স্টুডিয়োকে ঘিরে সেসময় মহিলাদের উৎসাহ ছিল তুঙ্গে। কোনও পুরুষ ফটোগ্রাফার নয়, মেমসাহেব নয়, তাঁদেরই মত। ক্যামেরা হাতে এক বাঙালি মহিলা।
সরোজিনী ঘোষ ছাড়াও আরো অনেকেই ছিলেন যারা নিয়মিত ফটোগ্রাফির চর্চা করতেন। মীরা চৌধুরী, অন্নপূর্ণা গোস্বামী, দেবলীনা সেন রায়, মনোবীণা সেন রায় এরা নিয়মিত ফটোগ্রাফির চর্চা করতেন।
দেবলীনা সেন রায়, মনোবীণা সেন রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে একটি ফটোগ্রাফির সিরিজ করেছিলেন, ‘টোয়েন্টি ফাইভ পোট্রেটস অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর’। ইলাস্ট্রেটেড ডেইলি’তে নিয়মিত তাঁদের ছবি প্রকাশিত হত।
বিবি উইন্স নামে এক বিদেশি মহিলা ফটোগ্রাফার কলকাতায় বাঙালি মহিলাদের ছবি তোলা শেখাতে শুরু করেন। বাংলায় ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রভাবে অনেক পরিবারই মেয়েদের শিক্ষার জন্য বহির্বিশ্বের দরজা উন্মুক্ত করেছিল। জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রগুলিতে ক্রমশ মেয়েদের দেখা যাচ্ছিল। সেই ধারাতেই স্ত্রী শিক্ষার মুক্ত হাওয়ায় বিবি উইন্স মেয়েদের ক্যামেরা শেখাতে লাগলেন।
১৮৮৫ সালে ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকাতে লেখাও হয় বিবি উইন্সের কথা।
শুধু মহিলা নয়, পুরুষ শিক্ষার্থীদেরও ক্যামেরা শেখাতেন তিনি। ইংল্যান্ড থেকে যে বিদ্যা শিখে এসেছিলেন নিজের বাড়িতে তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই চর্চাই করতেন।
১৮৮৬ পর্যন্ত টানা বিবির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে।
১৮৮৯ থেকে ১৯২৩ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান ফটোগ্রাফিক সোসাইটির জার্নালে কলকাতার বেশ কিছু বিদেশি মহিলা
ফটোগ্রাফারের নাম পাওয়া যায়।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ফটোগ্রাফির চর্চা করতেন বলে জানা যায়। রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ উপন্যাসের চরিত্র বিপ্রদাস আর কুমুদিনীকে দেখা যায় ফোটোগ্রাফিতে আগ্রহী। ১৯২৯ সালে লেখা উপন্যাসে স্ত্রী চরিত্রের হাতে ক্যামেরা তুলে দেওয়ার অনুপ্রেরণাও জ্ঞানদানন্দিনী কে দেখেই পেয়েছিলেন বলে আন্দাজ করা যায়।
জ্ঞানদানন্দিনীর কোন লেখা বা চিঠিপত্রে তাঁর ছবি তোলার উল্লেখ পাওয়া যায়নি। কন্যা ইন্দিরা দেবীর এক চিঠি থেকে বিষয়টি জানা যায়। সামনে আসে তাঁর শ্বশ্রূমাতা, রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবীর একটি ফটোগ্রাফ তুলেছিলেন। শোনা যায় সেটিই তাঁর একমাত্র আলোকচিত্র।