তাঁর সাড়ে সাত দশকের সঙ্গীত জীবন বাংলা গানের এক উজ্জ্বল সময়ের সাক্ষী। বাংলা গানের স্বর্ণযুগের অন্যতম এক নাম দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং বাংলা আধুনিক গান, দুই ধারাতেই সাবলীল তিনি। এক সরল রেখা প্রীতিয়মান হয়, পঙ্কজকুমার মল্লিক ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি তিনি ছিলেন বাংলা গানের পিতামহ। বাংলা গানে ভারী, পুরুষালি কণ্ঠের তেমন প্রাচুর্য ছিল না। দ্বিজেনবাবু সেখানেই প্রতিভূ। জলসায় হেমন্তর গান গাইতেন তিনি। হেমন্তই তাঁর প্রেরণা। তাঁর দেখানো পথে হেঁটেই আধুনিক গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীতেরও প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। পোশাকেও ছিল হেমন্তর প্রভাব হাতা গোটানো সাদা শার্ট ও ধুতি।
১২ নভেম্বর, ১৯২৭ উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরে বনেদি পরিবারে তাঁর জন্ম। গান নিয়ে বাড়িতে অনেক বিধি নিষেধ ছিল। গান না পসন্দ ছিল তাঁর। শ্যামবাজার এ ভি স্কুলে পড়াকালীন টিফিনের সময় বেঞ্চ বাজিয়ে গান করার সুবাদে এক গানের প্রতিযোগিতায় জোর করে দ্বিজেনবাবুর নাম দিয়ে দেন বন্ধুরা। বাড়িতে লুকিয়ে গান গাওয়া হল, পদকও জেতা হল। সঙ্গীত শিক্ষক সুশান্ত লাহিড়ির নজরে পড়ে গেলেন। গানের শিক্ষা শুরু হল। একবার রামমোহন হলে এক অনুষ্ঠান শুনতে গিয়ে উদ্বোধনী সঙ্গীতশিল্পীর অনুপস্থিতিতে, তাঁকে জোর করে মঞ্চে তুলে দেওয়া হয়। গান হল, মিষ্টির সঙ্গে খামে নগদ পাঁচটি টাকা জুটল! ভিত্তিপ্রস্থ এদ্দিনে গাঁথা হল স্থায়ীভাবে।
নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে মেগাফোন কোম্পানিতে ১৯৪৫ সাল প্রথম গান রেকর্ড করলেন ১৮ বছরের দ্বিজেন। অডিশন পেরিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে আরম্ভ করলেন। গ্রামোফোন কোম্পানি গান রেকর্ড করতে রাজি, টেলিফোন অপারেটরের চাকরি ততদিনে ছেড়ে দিয়েছেন। ষাটের দশক গানের রোজগারেই বিদেশি গাড়ি কিনেছিল তিনি। যেন উত্তর দিয়েছিলেন গান গেয়ে সব হয়।
তবে আজও মহিষাসুরমর্দিনী তাঁকে বাঙালির কাছে অমর করে রেখেছে। মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানে কোরাসে গলা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন আগেই। দ্বিজেনবাবুর লক্ষ্য ছিল মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানে একক গান গাওয়া। ১৯৫২ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মুম্বই চলে যাওয়ায় সুযোগ মিলল। সেই থেকে 'জাগো, তুমি জাগো' দ্বিজেনবাবুকে দিয়েই গাইয়েছেন পঙ্কজ মল্লিক।
সময়টা কেমন ছিল? আকাশবাণীর অফিসে অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন পঙ্কজ মল্লিক। এতদিন গান গেয়ে এসেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হঠাৎই বম্বে থেকে ডাক পেয়ে চলে গেলেন হেমন্ত। কে গাইবে ওই গান? চিন্তায় পঙ্কজ মল্লিক। মনে পড়ল এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর কথা। পঙ্কজ মল্লিক ডাকলেন তাঁকে। 'মহিষাসুরমর্দিনী'র অনুষ্ঠানে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ে কণ্ঠে আপামর বাংলা শুনল জাগো দুর্গা জাগো দশপ্রহরণধারিণী। মহিষাসুরমর্দিনীতে দ্বিজেনের গাওয়া সেই বিশেষ গানটি শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
সলিল চৌধুরী ও দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের যুগলবন্দী, বাংলার শ্রোতাদের হেমন্তর উত্তরসূরিকে চিনিয়ে দিয়েছিল। গণনাট্য সঙ্ঘের সুবাদেই দুজনের পরিচয়। শ্যামল বরণী ওগো কন্যা, পল্লবিনী গো সঞ্চারিণীর মতো গান বানালেন সলিল, গলা মেলালেন দ্বিজেন। সলিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের সনেটে সুর দিলেন। তৈরি হল, রেখো মা দাসেরে মনে, আশার ছলনে ভুলির মতো গান। গাইলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। সলিল চৌধুরীর সৌজন্যেই বাংলা ও হিন্দি ছবিতে গান করেন দ্বিজেন।
তবে এতকিছুর পরেও তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয় ছিল, তিনি রবীন্দ্র গানের শিল্পী। রবীন্দ্রসঙ্গীতের হাত ধরেই রেডিওতে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রথাগত রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষা ছিল না। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথকেও শুনিয়েছিলেন গান। তিনিই প্রথম যে আশ্রমিক না হয়েও বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন।