শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ ধামে ১৬ দিন ধরে চলে দুর্গার আরাধনা

জগন্নাথধামের রক্ষায়ত্রী এই দেবীকে দর্শন না করলে সম্পূর্ণ হয় না জগন্নাথ ধাম দর্শন। তিনি জগন্নাথধামের রক্ষায়ত্রী। দেবী বিমলা শ্রীক্ষেত্রের শক্তির উৎস। তিনিই আদ্যাশক্তি মহামায়া।

বিমলা মন্দির শক্তিপীঠ। এই শক্তিপীঠের দেবী কাত্যায়নী (বিমলা), ভৈরব জগন্নাথ। হেবজ্র তন্ত্র গ্রন্থে অনুরূপ একটি তালিকায় উড্র (ওড্র বা ওড়িশা) পীঠের ভৈরবী কাত্যায়নী ও ভৈরব জগন্নাথের উল্লেখ পাওয়া যায়। বেশ কয়েকটি গ্রন্থে বলা হয়েছে এই পীঠে সতীর নাভি পড়েছিল, আবার অনেকে বলেন সতীর পাদদেশ পড়েছিল এখানে। আবার সতীর উচ্চিষ্ট বা খাদ্যের অবশিষ্ট অংশ পড়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাপীঠ নিরুপণ গ্রন্থেও বিমলা ও জগন্নাথকে পীঠদেবতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দেবীর ১০৮টি পৌরাণিক নামের তালিকা নামাষ্টোত্তরশত গ্রন্থেও পুরুষোত্তমের বিমলার নাম পাওয়া যায়। দেবী পুরাণ মতে, এই পীঠে সতীর পা পড়েছিল।

পুরীর মন্দিরের বিমলা মন্দিরের প্রধান উত্‍সব হল দুর্গাপুজো। প্রতিবছর আশ্বিন মাসের ১৬দিন ধরে চলে দুর্গার আরাধনা। এই সময় আট দিনের জন্য তাঁর কাছে আসেন দুর্গামাধব। তিনি জগন্নাথের প্রতিনিধি। দেবীর সঙ্গেই এক বেদীতে পূজিত হন। নানা বেশে দেবী বিমলার পুজো হয়। তিনি নারায়াণী, সিংহবাহিনী, জয়দুর্গা, শূলী দূর্গা, বগলা, মাতঙ্গিনী, হরচন্ডীর মতো দ্বাদশ বেশে সাজেন। দুর্গাপুজোর শেষদিন মানে বিজয়াদশমীতে পুরীর গজপতি বংশের রাজা বিমলাকে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পুজো করেন।

জগন্নাথ মন্দিরের প্রথা অনুসারে, মেয়েদের “দুর্বল-হৃদয়” মনে করা হয়। তাই বিমলার ধ্বংসাত্মিকা রূপ মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা হয় বলে, বিমলা মন্দিরে দুর্গাপূজা মেয়েদের দেখতে দেওয়া হয় না। বিমলার “তীর্থ” বা পবিত্র জলাধার রোহিণীকুণ্ডের জল পবিত্র মনে করা হয়। তান্ত্রিকদের কাছে বিমলা মন্দিরের গুরুত্ব মূল জগন্নাথ মন্দিরের চেয়েও বেশি।

নতুন দিল্লি কোণার্ক শিলালেখ-এ এই পূজার প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শিলালেখের তথ্য অনুসারে, রাজা প্রথম নরসিংহদেব (রাজত্বকাল: ১২৩৮–১২৬৪) বিজয়াদশমীর দিন দুর্গা-মাধব (বিমলা-জগন্নাথ) পূজা করেছিলেন। সেই সময় বিমলা মন্দিরে পশুবলি হয়।

হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, দুর্গাপূজার সময় বিমলা ধ্বংসাত্মক রূপ ধারণ করেন, তাই সেই সময় তাঁকে শান্ত করতে আমিষ ভোগ নিবেদন করা উচিত। দুর্গাপুজোর সময় খুব ভোরে গোপনে পাঁঠাবলি দেওয়া হয়। স্থানীয় মার্কণ্ড মন্দিরের পুকুর থেকে মাছ ধরে এনে তা রান্না করে তান্ত্রিক মতে বিমলাকে নিবেদন করা হয়। এই সব অনুষ্ঠান ভোরে জগন্নাথ মন্দিরের দরজা খোলার আগেই সেরে ফেলা হয়। জগন্নাথের বৈষ্ণব ভক্তদের এই সময় বিমলা মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। অনুষ্ঠানের অল্প কয়েকজন দর্শকই "বিমলা পারুষ" বা বিমলার আমিষ প্রসাদ পান।

বিমলা মায়ের দুই পাশে দুই সঙ্গিনী জয়া আর বিজয়া। গর্ভ গৃহে আছে আরও দুটি কুলুঙ্গি। সেখানে অবস্থান করেন অষ্টভুজা দুর্গা আর ষড়ভুজা চামুণ্ডা।

বিমলা দেবীর পুজো হয় তন্ত্র মতে, পঞ্চমাকারে। পঞ্চমাকার উপাসনার অঙ্গ মৎস, মাংস, মদ্য, মুদ্রা এবং মৈথুন। দেবীর পূজার উপাচারে এই পাঁচের বিকল্প ব্যবহার করা। মৎসের বিকল্প হিং দিয়ে রান্না করা শাক। মাংসের বিকল্প আদা। মদ্যের বিকল্প কাঁসার পাত্রে ডাবের জল, মুদ্রার বিকল্প গোলা চিনি ও মইয়দা, মৈথুনের বিকল্প রক্ত চন্দনচর্চিত অপরাজিতা ফুল এবং শ্বেত চন্দনচর্চিত কলকে।

প্রতিদিন জগন্নাথের আরাধনের পরেই দেবীর পুজো হয়। দুর্গাপুজোর সময় হয় প্রধান উৎসব। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা নবমী থেকে শুক্লা নবমী পর্যন্ত টানা ১৬ দিন ধরে উৎসব চলে। এই সময় আট দিনের জন্য তাঁর কাছে আসেন দূর্গামাধব। তিনি জগন্নাথের প্রতিনিধি। দেবীর সঙ্গেই এক বেদীতে পূজিত হন। নানা বেশে দেবী বিমলার পুজো হয়। তিনি নারায়াণী, সিংহবাহিনী, জয়দুর্গা, শূলী দূর্গা, বগলা, মাতঙ্গিনী, হরচন্ডীর মতো দ্বাদশ বেশে সাজেন। এই সময় মৎস এবং মাংসের আমিষ ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। মেষ বলি হয়। তবে ভূমি স্পর্শ না করে, সবটা অনুষ্ঠিত হয়। জগন্নাথ মন্দির খোলার আগেই রাতের মধ্যে শেষ হয় এই পর্ব।

দশমী তিথিতে পুরীর রাজা স্বয়ং বিমলা মাকে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার রূপে আরাধনা করেন। যদিও মায়ের পুজো, তবু এই পুজোয় মহিলাদের প্রবেশাধিকার নেই। মায়ের উগ্রচন্ডারূপ তাঁরা সহ্য করতে পারবেন না তাই এই ব্যবস্থার চল।

জগন্নাথের মহাপ্রসাদ তাঁর দেবী বিমলার জন্যই হয়ে ওঠে ‘মহাপ্রসাদ’। প্রতিদিন জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরামকে ভোগ নিবেদনের পর ভোগের প্রধান পাত্র প্রতিদিন দেবী বিমলার মন্দিরে আনা হয়। তাঁকে নিবেদন করার পর সেই পাত্র শ্রী মন্দিরের গর্ভগৃহে ফিরিয়ে আনা হয়। সেই ভোগ অন্যান্য পাত্রে মিশিয়ে দিলে তবেই হয় তা মহাপ্রসাদ। তন্ত্রচূড়ামণি শাস্ত্র অনুসারে এই স্থানে সতীর খাদ্যের অবশিষ্ট অংশ পড়েছিল, তাই এই রীতি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...