১৮ দিন ব্যাপি দুর্গাপুজো

মল্লরাজাদের ইতিহাসের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় নেই, তা ভাবার কারণ নেই। কিন্তু সেই রাজাদের দুর্গাপুজোর ইতিহাস কিন্তু অনেকেরই অজানা। এই রাজপরিবারের পুজো বাকি আর পাঁচটা দুর্গাপুজোর মতো ছিল না, এমনকি আজও সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন সেই পরিবারের সদস্যরা। এই দুর্গাপুজোর মধ্যে কিন্তু রয়েছে আলাদা বিশেষত্ব। কী সেই বিশেষত্ব?

আসলে গোটা বিষয়টির সাথে জড়িয়ে রয়েছে ‘ঐশ্বরিক ব্যাখ্যা । অন্তত ইতিহাস ও লোককথা তাই বলে। দুর্গা নন, সেখানে পূজিত হন কুলদেবী মৃন্ময়ী। দীর্ঘ ১৮ দিন ব্যাপী এই পুজো চলে। মল্ল রাজবংশের ১৯ তম রাজা জয় মল্ল রাজত্ব করেছিলেন ৯৯৪-১০০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তিনি শিকার করতে গিয়ে দৈব নির্দেশ পান তার রাজধানী প্রদ্যুম্নপুর থেকে বনবিজ্ঞানপুরে স্থানান্তরিত করার জন্য এবং মা মৃন্ময়ী দেবীর মন্দির স্থাপনের জন্য (দেবী দুর্গার আর এক নাম ), সেখানে মাটি খুঁড়ে তিনি গঙ্গা মাটির তৈরী মা মৃন্ময়ীর মূর্তির ছোট মুখটি খুঁজে পান। ফিরে এসে ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন মন্দির।

পন্ডিত ও ঐতিহাসিকদের মতে রাজধানী স্থানান্তর এবং মা মৃন্ময়ীর প্রতিষ্ঠার কাজ এক সাথে করা হয়েছিল। যদিও বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করেন ৫৯তম মল্ল রাজা রামকৃষ্ণ সিংহ দেব, যিনি ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। সুতরাং, মা মৃন্ময়ী মন্দিরের দুর্গাপুজো বাংলায় এবং ভারতে সম্ভবত প্রাচীনতম, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

বিষ্ণুপুর রাজপরিবারের দুর্গাপুজো অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,  অন্যান্য দুর্গাপুজো কালিকাপুরান মতে হলেও এই পরিবারের পুজো হয় বলি নারায়ণী’ মতে। সেই প্রথা মেনেই নব্যমাদি কল্পারম্ভের সূচনা হয়। এক সময়ে বলি প্রথা থাকলেও রাজা হাম্বির মল্ল বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হলে তা বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে শব্দকে ব্রহ্ম জ্ঞান করেই তোপ ধ্বনি দেওয়ার রীতি শুরু হয়।

সেই ঐতিহ্য অনুসারেই শুরু হয় দুর্গোৎসব। মা মৃন্ময়ীর আরাধনায় প্রায় বিশ দিনের জন্য উৎসবে মেতে ওঠেন সেখানকার জনগোষ্ঠী। ‘জিতাষ্টমীর’ শুভ দিনে জিমুতবাহনের পূজা দিয়ে মহোৎসব শুরু হয়। ‘বড় ঠাকুরানী’, ‘মেজো ঠাকুরানী’ এবং ‘ছোট ঠাকুরানী’ নামে অন্য তিন দেবীও মা মৃন্ময়ীর সাথে পূজিত হন। তিন ঠাকুরানী পটে আঁকা হয় বলে, তাদের পটেশ্বরীও বলা হয়।

সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯) থেকেই রাজবাড়ি ও মৃন্ময়ী মন্দিরে চরম ব্যস্ততা। একদিকে পুজোর জোগাড় ও অন্যদিকে কামানে বারুদ ভরতে ব্যস্ত কারিগররা। বারুদ ঠাসা শেষ হতেই কামান বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মূর্চ্ছা পাহাড়ে। ১৮ দিন ওই পাহাড়েই রাখা হয় কামান। প্রথা ও ঐতিহ্য অনুযায়ী তোপধ্বনির মাধ্যমেই বড় ঠাকুরানীকে স্বাগত জানানো হয়। পটপূজার মাধ্যমে শুরু হল এ’বছরের পুজো। তারপর সেই পট আনা হয় মৃন্ময়ী মন্দিরে।

ইতিহাস জানায়, আগে পুজোর প্রতি নির্ঘণ্টই কামানের তোপ দেগে ঘোষণা হতো। তবে এখন তা আর নেই। তবু রাজপরিবারের সদস্যরা তোপধ্বনি করে পুজোর প্রাচীন ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন। অন্য দুই ঠাকুরানিকে যথাক্রমে মহা ষষ্ঠী ও মহা সপ্তমীর শুভ দিনগুলিতে স্বাগত জানানো হয়। মহা অষ্টমীর দিন অষ্টধাতু নির্মিত আঠারো হাতের বিশালক্ষীর মূর্তির পূজা করা হয়। পঞ্জিকা অনুসারে সন্ধি পুজোর সময়টি জলঘড়ির দ্বারা নির্ধারিত হয়। ওই শুভ মুহূর্তের সূচনায় মূর্চ্ছা পাহাড়ে কামান ফাটানো হয় যাতে মা মৃন্ময়ী দেবী মন্দির সংলগ্ন পুরো অঞ্চল এবং এর আশেপাশে বিষ্ণুপুর ও হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়ে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হতে পারে।

নবমীর শুভ দিনে দেবীর পুজো হয়। দেবী দুর্গার এই অবতারকে ভয়ঙ্কর বলে মনে করা হয়। মন্দিরে একটি গভীর নীরবতা সর্বোচ্চ বিরাজ করে , সাধারণ মানুষদের মন্দিরে প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। দশমীর দিন একটি পবিত্র ‘হোম’ হয়। তারপরে বিসর্জন হয় তিন ঠাকুরানির ও ঘট। দশমীর সন্ধ্যায় নীলকণ্ঠ পাখি মা মৃন্ময়ী দেবীকে যথাস্থানে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন সদস্যদের, তবে তার বিসর্জন হয় না।

বিভিন্ন বাধার কারণে কিছু আচার-অনুষ্ঠান আর অনুসরণ করা হয় না। বিষ্ণুপুর সংগীতের পবিত্র স্থান হওয়ায়, বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে মা মৃন্ময়ী দেবীর মহান উৎসবে। পণ্ডিতদের মতে পুজোর সময় উচ্চারিত মন্ত্রগুলিতে ধ্রুপদী সংগীতের বিভিন্ন রাগের সুর থাকে। তবে এখানে ‘কলাবউ’ পুজো করার কোনও রীতি নেই। এভাবেই প্রথা মেনে মল্ল বংশের পুজো আজ তার স্বকীয়তা বজায় রেখে চলেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...