'এসো মা আনন্দময়ী এ দীনের কুটিরে'

কাশ ও শরতের আকাশ এখনও অবিকল আদিম। আজ বলব বছর চল্লিশ আগের গপ্পো। তখনও ভাদ্র শেষ হতেই কাশের বনে যৌবনবতী কাশমঞ্জরীরা চোখ তুলে থেকে থেকে আকাশের পানে চাইত। শরৎ-আকাশের আয়নায় নিজেদের মুখ দেখে সচেতন সুন্দরীর মতো হাওয়ার দোলায় হেসে উঠত। জানান দিত, পুজো আসছে।

anadamoyi-1

তখন গাঁয়ে গাঁয়ে মাটির বাড়ি; খড়ের, টিনের, টালির চাল। দুই কুঠুরির ঘর, সামনে একফালি বাঁশের খুঁটির জলবারান্দা। বারান্দা থেকে একখণ্ড মাকড়া পাথর বেয়ে নামলেই অনেকখানি উঠোন। উঠোনের দুই দিকে পরের ঘরের দেওয়াল। একদিকে সদর রাস্তা থেকে উঠোনে ঢোকার এক ফালি পথ, অন্য ফালিতে দিশি টগরের গায়ে গা ঠেকিয়ে বেয়াড়া একখান শিউলি। গাছের তল বিছিয়ে শেষ রাতের ফুল। তারই নীচে গোবর নিকোনো আলপনা আঁকা তুলসীতলা। তুলসী গাছের নীচে শাঁখডাকা সন্ধ্যের তেল-প্রদীপের দাগ। দুর্গাপুজোর চারটে দিন মেয়েজামাই-আত্মীয়স্বজন-কুটুমবাটুমের ভিড় হত এই বাড়িতেই।

সব গ্রামেই সম্ভ্রান্ত দু'চাট্টি বিশিষ্ট বাড়ি ছিল। সেগুলো ইঁট-সিমেন্ট-পলেস্তারায় পাকা; নীলে-চুনে কিংবা লাল-হলুদ এলায় রঙিন। লোডশেডিং-এর ধাক্কা সামলে ঘরে-দোরে হলদে আলোর ডুম। সিলিং জুড়ে বনবন পাখা। গাঁয়ের ছড়ানো-ছিটানো নির্বিশেষ মাটির ঘরে ঘরে তখন হ্যারিকেনের আলো, ছিপিতে ফুটো করে সলতে টুকিয়ে শিশির পেটে কেরোসিন ঢেলে জ্বালানো কুপি। অথবা, ছোট্ট টিনের কৌটোর ঢাকনায় ফুটো করে বানানো, টিমটিমে ডিবের আলো। হাতপাখার বাতাস। তালপাতার পাখা, কাপড়ে ফুল তোলা ঝালর বসানো বাঁশের ফ্রেমের পাখা, গম গাছের ডাঁটা দিয়ে বানানো পাখা--কতরকমের বাহারি পাখা যে ঘরের মেয়েরা অলস দুপুরে বানানোর অবসর পেতেন তখন! শুধু তাই নয়, সেইসব পাখার বুকে লিখে দিতেন এক কলম ছড়া :

'তালের পাতায় জন্ম তোমার,

ওগো হাতের পাখা।

শীতকালের শত্রু তুমি

গ্রীষ্মকালের সখা।।' 

anadamoyi-2

মাটির ঘরের ভেতর শীতে ওম, গরমে শেতল। তা হোক, তবু তো চাষিবাসীর ঘর। সারাবছর এই-শস্যে, সেই-শস্যে ঘর ভরা। বিড়েদড়ি বাঁধা গোলা ভরা উঠোন। উঠোনের এক কোনায় শেষ হয়ে আসা বিচুলির গাদা। ঘরে-বাইরে তাই পাল পাল ইঁদুরের উৎপাত। জাঁতিকল-খাঁচাকলে হাজার কলকাঠি নেড়েও কিছুতেই তাদের যেন বাগে আনা যেত না। বিষেও নির্বিশেষে নিঃশেষ হত না ব্যাটারা! সারাটা ঘরের মেঝে, দেওয়াল; মায় খড়ের চাল অব্দি তারা লেন্ডিগেন্ডি-বাচ্চাকাচ্চা-বোনাই-বেয়াই সক্কলে মিলে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলত। পুজোয় জামাইকুটুম ঘরে আসবে, তাদের তো আর এমন হদ্দ ঘরে রাখা যায় না। তাই মাসখানেক আগে থেকেই চলত ঘর সারাইয়ের কাজ। মেঝে নিকিয়ে, গর্ত বুজিয়ে ঘরবারের ঝুল ঝাড়াই করে দেওয়ালে রঙ বোলানো হত। রঙ হত খড়িমাটি দিয়ে। গাঁয়ের পথে পথে পুজোর আগে মাথায় ঝাঁকা নিয়ে খড়িমাটি বেচতে আসত একদল মেয়ে-বউ-পুরুষ। খড়িমাটির খনি থেকে মাটি তোলাই তাদের কাজ। মাটি তুলে শুকিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে বেচাই তাদের পেশা। এ-কাজে অনেক খাটুনি। অথচ, পথে হেঁকে হেঁকে খড়ি বিক্রি করত তারা সেই কোন আদ্যিকালের বিনিময় প্রথায়, দু'সের ধানে এক সের খড়ির হিসেবে।

রাতভর খড়িমাটি ভিজিয়ে জলে গুললেই তৈরি হত থকথকে রঙ। দুধ সাদা। সেই রঙ কাপড়ের ন্যাতা দিয়ে সারা দেওয়ালে দুই কোটে রঙ বোলানো হত। খড়িমাটির ছোঁয়ায় মাটির দেওয়াল হয়ে উঠত অবিকল হাতির দাঁতের মতো অমল ধবল মসৃণ। কখনও কখনও খড়িমাটির রঙের সঙ্গে কাপড়ে দেওয়ার নীলবড়ি মেশানো হত। তাতে দেওয়ালের রঙ হয়ে উঠত, শরতের আকাশের মতো চোখ জুড়ানো নীল। 

 

anadamoyi-3

ঘরদোর ঝকঝকে তকতকে হয়ে গেলে আর একটাই কাজ বাকি থাকত তখন, সেটা হল অলংকরণ। সরু কাঠির মাথায় পাতলা ন্যাকড়া জড়িয়ে তুলি বানিয়ে  লাল-হলুদ গেরিমাটি, আলতা এবং নীল দিয়ে নানান ফুল ও লতাপাতা আঁকা হত। আঁকা হত, দরজা ও জানালার তিন দিক ঘিরে শাড়ির পাড়ের মতো সাজিয়ে। সদর দরজার মাথার ওপর দেবীমাকে আবাহন করে লেখা হত , 'এসো মা আনন্দময়ী এ দীনের কুটিরে'।  

anadamoyi-4

 

তখন এক-গাঁ দু-গাঁ পেরিয়ে এত পুজো তো আর হত না; চার মাইল পথ ঠেঙিয়ে একখানা পুজো দেখেও অজস্র অভাবের মাঝে অফুরন্ত আনন্দ পেতেন মানুষ। আজকের অনেক পাওয়ার মাঝে অবশ্য হারিয়ে গেছে সেই গ্রাম, হারিয়ে গেছে সেই আটপৌরে আনন্দযাপনের বাসনাও। তবে, দেবীর আগমনী পথের দিকে চেয়ে সেদিনও যেমন গ্রামের মানুষ বসে থাকতেন, আজও বসে থাকেন তেমনি। আসলে, অপেক্ষার কোন সেকাল-একাল নেই। ছিলও না কোনকালে...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...