দুর্গাপুজো বাঙালির ঐতিহ্য- পাড়া বদল হোক বা দেশ

ও.. আয় রে ছুটে আয়

পুজোর গন্ধ এসেছে।

ঢ্যাম্ কুড়কুড়, ঢ্যাম্ কুড়াকুড়

বাদ্যি বেজেছে।

গাছে শিউলি ফুটেছে

কালো ভোমরা জুটেছে।

আজ পাল্লা দিয়ে আকাশে

মেঘেরা ছুটেছে।

 ছোটবেলায় এই গান দিয়ে আমার পুজো শুরু হতো। বাড়ির রেডিওতে এই গানটা তখন বেশি করে বাজত। ছোটবেলায় আমার পাড়ার পুজো মানে বাড়ির ঠিক পাশেই পাড়ার ক্লাবের পুজো। এখনও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই পুজো মণ্ডপের বন্ধ গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ফ্রক পরা মেয়ে- ঠাকুর তৈরি দেখছে। স্কুল থেকে ফিরেই চলে যেতাম ঠাকুর বানানো দেখতে, তখন থেকেই মনে আনন্দ হতো পুজো আসছে এই ভেবে।

পুজোর দিন গুলোতে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে সকাল সকাল স্নান করে উপস্থিত হতাম পুজো মণ্ডপে- পুজোর টুকটাক কাজের দায়িত্ব ছিল আমাদের উপরে, যেমন - কাটা ফল সাজানো, গাঁদা ফুল কুঁচনো, পদ্ম ফুল ফোটানো, ঘটে সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক চিন্হ আঁকা, নৈবিদ্য সাজানো .. আরও কত কি! ব্যাস্ততার শেষ ছিল না, নাওয়া খাওয়া ভুলে মণ্ডপেই পরে থাকতাম সারাদিন। ঠাকুরমশাই নিজে বলে বলে সব কাজ শেখাতেন। তখন ক্লাস ৩ তে পড়ি- আমাদের কাজের বহর দেখে সবাই অবাক হয়ে যেত। 

এরপর বিকেল হলেই নতুন জামা পরে মণ্ডপে যাওয়ার উত্তেজনা। তখন তো আর এখনকার মত খান দশেক জামা কাপড় হতো না, ২-৩ টে জামা মানেই অনেক। কিন্তু তাতে পুজোর আনন্দ একটুও কম হতো না। ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা, এগরোল- আইসক্রিম খাওয়া,  কত টুকরো টুকরো স্মৃতি!

এরপর ধীরেধীরে বয়েস বাড়ে, বিয়ে হয়, চলে যাই ‌ শ্বশুর বাড়ি। মা মাসীরা বলতো মেয়েরা হল তরলের মতো যে পাত্রে রাখবে তার আকার নেবে। তাই শ্বশুর বাড়ির পাড়াই হয়ে গেল আমার পাড়া। কিন্তু তবুও আজ নিজের বাড়ি ছেড়ে, পাড়া ছেড়ে থাকি এই বিদেশ বিভূঁই এ। কোন বছর পুজোতে দেশে ফিরে কোনো বছর মায়ের মুখ দেখার সৌভাগ্য ও হয় না।  কিন্তু যখনই নিজের পাড়ার মন্ডপে গিয়ে মায়ের মূর্তির সামনে দাঁড়ায় তার অনুভূতি তাই আলাদা।  চারিদিকের চিত্রটা আজও বদলায়নি-  বাচ্চাদের ক্যাপ বন্ধুকের শব্দ, নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ,কম বয়সী ছেলেপুলেদের খুনসুটি, নতুন প্রেমের সূচনা,পাড়ার দাদাদের কাজের ব্যস্ততা... সব সবকিছু একইরকম।

আসলে এই পুজো আমাদের বাঙালির ঐতিহ্য- সে যতই পাড়া বদল হোক আর দেশ। এই পুজো অনেক কিছুর সাক্ষী- আমি আমার মুসলমান বন্ধুটিকে মা দুর্গা কে হাত জোড় করে প্রনাম করতে দেখেছি, পাড়ার অহংকারী বড়লোক কাকুটিকে সকলের সাথে বসে অষ্টমীর খিচুড়ি ভোগ খেতে দেখেছি, ঢাকির ছেলের সাথে পাড়ার বাচ্চাদের লজেন্স ভাগ করে খেতে দেখেছি, আবার বনিবনা না হওয়া শাশুড়ি বউ কেউ দেখেছি দশমীর দিন একে অপরের গালে আর সিঁথিতে হাসি মুখে সিঁদুর লাগিয়ে দিতে - এসব কি ভোলার জিনিস!

এই সমস্ত না ভোলা স্মৃতি নিয়েই আমাদের বয়েস বাড়বে, পাড়া বদলাবে, দেশ বদলাবে কিন্তু ঐতিহ্য? আবেগ? কোনো দিন বদলাবে না। যেখানেই থাকি না কেন, পুজো যে অংশগ্রহণ করতে পারি আর নাই পারি, প্রতি বছর দশমীর পর মনেমনে একবুক আশা নিয়ে ঠিক বলবো- আসছে বছর আবার এসো মা!

 

                                                           

(Bengali Community of The Netherlands ' হৈ চৈ'-এর তরফে প্রবাসে বসে প্রবন্ধটি লিখেছেন: সংহতি দত্ত)

বিশদে জানতে ক্লিক করুন এই লিঙ্ক-

https://www.hoichoi.nl

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...