" দুর্গা দুর্গতি নাশিনী" বলা হলেও বাঙালির দুর্গা কিন্তু বাড়ির মেয়ে। মেনকা সারাবছর মেয়ের অপেক্ষায় দিন গোণে। হিমালয়ের কাছে আকুতি মিনতি চলে মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য। আর মেয়ে উমা ফি বছর চার পোলাপান সঙ্গে নিয়ে চারদিনের জন্য বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে যায়। এই উমা কোথাও দুর্গা, কোথাও পার্বতী আবার কোথাও মহিষাসুর মর্দিনী।
দুর্গা শব্দের বুৎপত্তি হল দুর্ (দুঃখ) গম ( গমন করা, জানা) + অ (র্ম্ম)= দুর্গ+আ ( স্ত্রীং) অর্থাৎ যাঁকে দুঃখে জানা যায়। কিংবা যিনি দুর্গ অর্থাৎ সংকট থেকে মুক্তি দেন। শব্দকল্পদ্রুম অনুসারে যিনি দুর্গ বা দুর্গম নামে অসুরকে হত্যা করেছিলেন, তিনি দুর্গা। " দুর্গং নাশয়তি যা নিতং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা"। শ্রী শ্রী চণ্ডী অনুসারে, যে দেবী " নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ" ( সমস্ত দেবতা সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি), তিনিই দুর্গা।
বাংলায় সাধারণত আশ্বিন এবং চৈত্র মাসে দুর্গাপুজো হয়। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয়া বা দুর্গাপুজো বাঙালির কাছে বেশি জনপ্রিয়। এটি অকাল বোধন হিসেবেও পরিচিত। চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে হয় বাসন্তী পুজো। "কালিকাপুরাণ" এবং "বৃহদ্ধর্মপুরাণ " অনুসারে রাবনকে বধ করার জন্য শরৎকালে দুর্গা পুজোর আয়োজন করা হয়েছিল। হিন্দুশাস্ত্র মতে শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই এই সময়ে দেব-দেবীর পূজা করা যায় না। অকালে পুজো করা হয়েছিল বলে দুর্গাপুজো "অকাল বোধন"। এই অকালবোধনের করতে ব্রহ্মা রামকে বলেছিলেন। কবি কৃত্তিবাসী ওঝাও তাঁর "রামায়নে" অকাল বোধনের কথা উল্লেখ করেছেন।
মৎসপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ, কালিকা পুরাণ ও দেবী ভাগবতে দুর্গার কথা পাওয়া যায়। মহাভারতের বিরাট পর্বেও দুর্গার বর্ণনা রয়েছে। দুর্গার আলোচনা ও পূজাবিধিতন্ত্রও পুরাণে উল্লেখিত। শাক্তধর্মে তিনি সর্বোচ্চ আরাধ্যা দেবী। বৈষ্ণব ধর্মে তাঁকে ভগবান বিষ্ণুর অনন্ত মায়া আখ্যা দেওয়া হয়েছে। শৈবধর্মে দুর্গাকে শিবের অর্ধাঙ্গিনী পার্বতী হিসেবে অর্চনা করা হয়। হিন্দুধর্মে দুর্গা হল পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। " কেনোপনিষদে" বর্ণিত হৈমবতীকে দুর্গারূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের যোগমায়া হল দুর্গা। দুর্গার ভিন্ন ভিন্ন অবতারগুলি হল- কালিকা, নন্দা, ভ্রামরী, শাকম্ভরী, রক্তদণ্ডিকা, সতী, পার্বতী এবং কৌশিকী। হিন্দু পুরাণ মতে তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, গণেশের জননী। বাংলা মঙ্গলকাব্য ও আগমনী গানে দুর্গারূপে শিবজায়া হিমালয়-দুহিতা পার্বতীর সপরিবারে পিতৃগৃহে অবস্থানের আনন্দময় দিন এবং বিবাহিত জীবনের অপূর্ব বর্ণনা রয়েছে।
খ্রিষ্টীয় ৪০০-৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী শাক্ত ঐতিহ্যের পুণর্জাগরণ হয়েছিল। মহাযান বৌদ্ধধর্মের হাত ধরে দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ, চিন, জাপান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, তিব্বত, ভুটান, মালয়েশিয়া ও মঙ্গোলিয়া। কম্বোডিয়া আর ইন্দোনেশিয়াতে দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য পূজিত হত। জাভা ও ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন অংশ থেকে উদ্ধার হয়েছে মহিষাসুর মর্দিনী মূর্তির প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ।
ইন্দোনেশিয়ায়, সেন্ট্রাল জাভাতে রয়েছে নবম শতাব্দীর বিখ্যাত হিন্দু মন্দির প্রাম্বানান। এই মন্দিরে আছে জগৎ বিখ্যাত মহিষাসুর মর্দিনী মূর্তি। ১৫০০-১৬০০ শতাব্দীর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় মহিষাসুর মর্দিনীর পুজো সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইসলামের আগমনের পর দুর্গার আরাধনা পাড়ি জমায় আরও পূর্বদিকে হিন্দু বালিতে। কম্বোডিয়া থেকে যে দুর্গা মূর্তিগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো অধিকাংশ চতুর্ভুজা এবং মহিষাসুর মর্দিনী।
দুর্গাকে অনেকে শস্যের দেবী বলেন। তাই তিনি "শাকম্ভরী" নামে পরিচিতা। শাক শব্দের মধ্য দিয়ে জগতের সমস্ত শস্যকে বোঝানো হয়েছে। তিনি শুধু শস্য রক্ষার দেবী নন, তিনি স্বয়ং শস্য। ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর "ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য" গ্রন্থে বলেছেন ' এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে এর পূজা করা হয়। তাহার কারণ শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্যদেবীরই পূজা। পরবর্তীকালে বিভিন্ন দুর্গা পূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। ......... বলা বাহুল্য এইসবই হইল পৌরাণিক দুর্গা দেবীর সহিত এই শস্য দেবীকে সর্বাংশে মিলিইয়া লইবার একটি সচেতন চেষ্টা। এই শস্যদেবীর মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ। সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গা পূজার ভিতরে এখনও সেই আদি মাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে '।
প্রথম খ্রিষ্টাব্দে রাজস্থানের নাগোর নামের গ্রাম থেকে ভারতের প্রথম দুর্গা মূর্তিটির সন্ধান পাওয়া যায় । এই মূর্তিটি ছিল মহিষ মর্দিনী, মহিষাসুর মর্দিনী নয়। তিনি গৌরবর্ণা নন, কৃষ্ণ ও কালো রঙের। এই দুর্গার হাত মাত্র দুটি এবং তাতে কোন অস্ত্র নেই। নগ্ন শবরী মহিষ মর্দিনী দুর্গা এখানে সম্পূর্ন নগ্ন। প্রায় উলঙ্গিনী দুর্গা পাওয়া যায় চতুর্থ শতকে মধ্যভারতে। তাঁর উর্দ্ধাঙ্গ অনাবৃত। কোমর থেকে উরু পর্যন্ত বস্ত্র আছে, তাও শতচ্ছিন্ন। এই দুর্গার চারটি হাত। তিনি মহিষাসুরকে হত্যা করেছেন। এই মহিষাসুরের দেহ মহিষের আর মাথা মানুষের।
প্রাচীন দুর্গা মূর্তিগুলোতে দুর্গা মূলত মহিষ বা মোষ হত্যাকারিণী হিসেবেই পাওয়া যায়। মহিষ নামের কোন ভয়ঙ্কর অত্যাচারী অসুর নয়। ষষ্ঠ শতাব্দীর "শিলাপদ্দিকারম" গ্রন্থে দুর্গার চারটি হাত। ডানদিকের একটি হাতে ত্রিশূল। বাকি দুটি হাতে যথাক্রমে শঙ্খ ও চক্র। একটি হাত বরাভয় মুদ্রা। তিনি কাটা একটি মহিষের মুণ্ডর উপর দাঁড়িয়ে আছেন। এক শতাব্দী থেকে আরেকটি শতাব্দীতে দুর্গার রূপের পরিবর্তন হয়েছে। আর মহিষ, মহিষাসুরে বদলে গেছে। দুর্গা হয়ে গেলেন মহিষ মর্দিনী থেকে মহিষাসুর মর্দিনী।
অনেকের মতে মহিষাসুর হলেন অনার্য গোষ্ঠীভুক্ত। তাঁকে এক অন্যায় যুদ্ধে পরাজিত করেন আর্যদেবী দুর্গা। সেই কারণে বোধহয় আজও অসুর পুজো হয়। ঝাড়খন্ড ও জলপাইগুড়ি জেলায় "অসুর" নামে একটি আদিবাসী গোষ্ঠী বসবাস করে। ঝাড়খন্ডের অসুর সম্প্রদায়ের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় দশহাজার। মহিষাসুরের উপাসক বিহার, মধ্যপ্রদেশ এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও দেখা যায়। তাঁরা দাবি করেন তাঁরা মহিষাসুরের বংশধর। এঁরা দুর্গাপুজোর সময় মহিষাসুর পুজোর মধ্যে দিয়ে শোক পালন করে থাকেন। পুরুলিয়ার "ভুলুরডিতে" ২০০৩ সালে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অসুর পুজো আরম্ভ হয়েছে।
নৃতাত্ত্বিকদের মতে বাংলার প্রাচীন জনগোষ্ঠী ( নিষাদ, কোল, ভীল ইত্যাদি) মানুষেরা অসুর গোষ্ঠীভুক্ত। আদিবাসী লোককথা অনুযায়ী "হুদুড়দুর্গা ঘোডাসুর" অর্থাৎ রাজা মহিষাসুর যুদ্ধে বিদেশী আর্য নারী দ্বারা পরাজিত হয়ে রাজ্যপাট হারায়। ষাঁড়, বলদ, মোষ প্রধান তাঁদের জীবনে। তাঁদের রক্ষাকর্তা হলেন মহিষাসুর। সেই রাজা মহিষাসুরকে হত্যা করে দুর্গা। বৈদিক তথা হিন্দুত্বের বশ্যতা স্বীকার করানো ছিল মূল উদ্দেশ্য। দুর্গা হলেন বিপদ রক্ষিনী মাতৃত্বের প্রতীক দেবী, অন্যদিকে অসুর হল অনুন্নত ঘৃন্য জীব।
"দাশাই পরব" অসুর আদিবাসীদের একটি শোক পালনের পরব। পাঁচ দিন ধরে চলে এই শোক পালন। বিদেশীরা তাঁদের প্রিয় রাজাকে এক নারী দিয়ে হত্যা করিয়েছে। তাই নারীর ছদ্মবেশে যোদ্ধারা তাঁদের রাজাকে খুঁজতে বেড়োয়। মুণ্ডা, কোল সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা দাবি করেন দুর্গা তাঁদের মেয়ে। হাঁড়ি সম্প্রদায়েরও দাবি দুর্গা (চণ্ডী) তাঁদের মেয়ে। দেবতারা তাঁকে দিয়ে তাঁদের রাজাকে হত্যা করিয়েছে। আজও তাঁরা ' হায়রে ও হায়রে' বলে ভুরাং নাচের মাধ্যমে তাঁদের রাজাকে খুঁজে বেড়ায়। মালদা, দিনাজপুর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাতে ইদানিং অসুর পুজো দেখা যাচ্ছে।
প্রথম যে দুর্গার মূর্তিগুলি পাওয়া গিয়েছিল, তাতে দেবী দুর্গার হাত দুটি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেবীর হাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। চতুর্ভূজা, ষড়ভূজা, দশভূজা, দ্বাদশভূজা, অষ্টাদশভূজা এবং দ্বাত্রিংশৎভূজা। তবে আট ও দশ হাতের সংখ্যাই বেশি। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত দশভূজা মূর্তিই মানুষের কাছে বেশি গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে।
দেশের যেখান থেকেই দুর্গার মূর্তি পাওয়া গেছে, সব জায়গায় দুর্গা একা। সে রণরঙ্গিনী। সন্তান-সন্ততি কেউ নেই। ব্যতিক্রম শুধু বাংলায়। এখানে দুর্গার সঙ্গে তাঁর সন্তান-সন্ততি রয়েছে। বাঙালি দুর্গা বা বলা ভালো উমা বাপের বাড়িতে আসে। চারদিন বাপের বাড়িতে কাটায়। দশমীর দিন জামাই শিব শ্বশুর বাড়ি এসে মেয়েকে আবার কৈলাসে নিয়ে যায়। বেজে ওঠে বিষাদের সুর। আবার শুরু হয় এক বছরের জন্য অপেক্ষা।