খুব সকালে যে-কোন সাত্ত্বিক মানুষ পুজোর অর্ঘ্য ফুল-তুলসী তোলার আগে তুলসী বা ফুল গাছের কাছে ছোট্ট করে হাততালি দেন, যাতে গাছটির রাত্রিকালীন নিদ্রা সেই শব্দে ভঙ্গ হয়। ঘুমন্ত গাছ থেকে ফুল-পাতা-ফল তুলতে নেই, জাগিয়ে তারপর তুলতে হয়, এই তাঁদের বিশ্বাস। এই যে জাগানো, একেই বলে, 'বোধন'। দেবী দুর্গার শরৎকালীন পুজোয় যে 'বোধন' কথাটি প্রযুক্ত হয়, সেটিও ওই 'জাগানো' অর্থেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই 'বোধন'-এর সঙ্গে শরৎকালীন দুর্গা পুজোয় 'অকাল' শব্দটি প্রযুক্ত হয় কেন?
শাস্ত্র মতে, মাঘ মাস থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত যে ছ'মাস, এই ছ'মাস দেবতাদের কাছে এক দিন। এই সময় দেবী ও দেবতারা জেগে থাকেন। আর, শ্রাবণ মাস থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত যে ছ'মাস, তাঁদের কাছে হল একটি রাত্রি, এই সময় তাঁরা ঘুমিয়ে থাকেন। এই হিসেবে আশ্বিন মাসটি হচ্ছে মাঝরাত্তির। এই সময় দুর্গা পুজো করার অর্থ, অকালে জাগিয়ে (অর্থাৎ, বোধন করে) পুজো। তাই এ-সময়ের পুজো 'অকাল বোধন'-এর পর অনুষ্ঠিত হয়।
দেবী দুর্গার সঠিক সময়ে অর্থাৎ জাগরণকালে পুজো হয় চৈত্র মাসে। তখন তিনি 'বাসন্তী' নামে পূজিতা হন।
'মহাভারত', 'বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ' এবং কৃত্তিবাস ওঝা রচিত 'রামায়ণ' কাব্যে আমরা দেখেছি যে, রামচন্দ্র অকাল বোধনের পর শরৎকালে দেবী দুর্গার পুজো প্রচলন করেছিলেন। ব্যাসদেব রচিত 'মহাভারত'-এর 'বনপর্ব'-এ এই পুজোর প্রথম এবং বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে।
সেই বিবরণে দেখা যায় যে, রামচন্দ্র নবরাত্রব্রত রেখে রাবণবধের জন্য দেবীর কৃপালাভের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আশ্বিন মাসে দুর্গা পুজো করেন। দেবীর চরণে অর্ঘ্য দেবেন বলে সংগ্রহ করেন একশো আটখানা নীল পদ্ম।
ভক্তকে ভগবান প্রথমে পরীক্ষা করেন, তারপর তাকে কৃপা করেন-এটা পৌরাণিক কাহিনির বিশেষত্ব। এখানেও তার ব্যতিক্রম হল না। দেবী একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখলেন। ফলে, পুজো সম্পূর্ণ করতে ফুলের অভাবে রামচন্দ্র পদ্মের মতো নিজের নীল একটি চোখ উপড়ে দেবীর চরণে নিবেদন করতে গেলেন। রামচন্দ্রের এই নিবেদনে দেবী দারুণ তুষ্ট হলেন এবং রাবণবধ করে সীতা উদ্ধারের বর দিলেন।
বলা বাহুল্য, বাল্মীকি রচিত 'রামায়ণ'-এ রামচন্দ্র কর্তৃক দুর্গা পুজোর কোন উল্লেখ নেই। তবে, কৃত্তিবাসী 'রামায়ণ'-এ রাবণবধের পূর্বে যেমন অকাল বোধনের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, তেমনি বানরসেনাসহ সমুদ্র পেরনোর আগে দেবীর সহায়তা চেয়ে রামচন্দ্র কর্তৃক দুর্গাস্তবেরও উল্লেখ আছে।
ব্যাসদেব রচিত 'মহাভারত'-এ শ্রীরামের দুর্গা পুজোর কাহিনির পাশাপাশি 'বিরাট পর্ব'-এ পঞ্চপাণ্ডব কর্তৃক দুর্গা-আরাধনার কথা জানা যায়। তাঁরা যখন অজ্ঞাতবাসের উদ্দেশ্যে ছদ্মনাম নিয়ে অস্ত্রশস্ত্র বৃক্ষের পত্রান্তরালে লুকিয়ে বিরাট নগরে প্রবেশ করছেন, তখন যুধিষ্ঠির এই অজ্ঞাতবাসের সাফল্য কামনায় দেবীর স্তব করলেন এই বলে যে:
'দুর্গাৎ তারয়সে দুর্গে তৎ ত্বঙ দুর্গা স্মৃতা জনৈ:...।'
এ-তো গেল 'রামায়ণ'-'মহাভারত'-এর কথা। প্রাচীন বেদ-পুরাণে দুর্গা পুজোর কোন প্রসঙ্গ আছে কি না, সে-সব আসুন একটু খুঁজে দেখি:
ঋক্ বেদে সরাসরি 'দুর্গা' নাম বা দেবীর উল্লেখ না-থাকলেও এই বেদের মন্ত্রে যজ্ঞবেদিকে 'অগ্নিময়ী দেবী' ও 'দক্ষ তনয়া' বলেই ঋষিরা বর্ণনা করেছেন। এই বেদেরই 'খিলসূক্ত'-এর মন্ত্রে 'রাত্রিদেবী' নামে আর-এক দেবীর উল্লেখ আছে। পণ্ডিতদের অনুমান, এই দুই মিলে পরবর্তীকালে দেবী দুর্গার সৃষ্টি হয়।
বেদসমূহে 'দুর্গা' নামের উল্লেখ না-থাকলেও পরবর্তীকালের বৈদিকশাস্ত্র 'তৈত্তিরীয় আরণ্যক'-এর 'নবম অনুবাক'-এ দুর্গার গায়ত্রী মন্ত্র আছে, যথা:
'কাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যাকুমারিং ধীমহি তন্নো দুর্গি প্রচোদয়াৎ...।'
এছাড়াও এই আরণ্যক-এ দেবীর সঙ্গী হিসেবে শিব-কার্তিক-গণেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্বাচীনকালের 'বহ্বৃচ উপনিষদ' ও 'দেবী উপনিষদ' প্রভৃতি বেদোত্তর শাস্ত্রেও দুর্গার কথা ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে।
দেবীর মহিষমর্দিনীরূপ, যে-রূপে আমরা শরতে তাঁর আরাধনা করি, সেই রূপের মাহাত্ম্য-উপাখ্যান প্রথম আমাদের সামনে তুলে ধরেন 'মার্কণ্ডেয় পুরাণ', তাঁর 'দেবী মাহাত্ম্য' অংশে। সেখানে মহিষাসুরের অত্যাচার এবং তা থেকে মুক্তির জন্য দেবতাদের সম্মিলিত তেজে দেবীর দশভুজারূপে আবির্ভাব, দেবতাদত্ত আয়ুধে সজ্জিত ও সিংহবাহিনী হয়ে দেবীর মহিষাসুর বধ--সমস্তই বর্ণিত।
নরলোকে ও দেবলোকে দেবী পূজার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় 'ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ'-এ। সেখান থেকেই জানা যায় যে, রাজা সুরথ ও বণিক সমাধি প্রথম মাটির মূর্তি গড়ে দেবীর পুজো করেন। এছাড়াও বসন্তকালে স্বয়ং কৃষ্ণ যে রাসমণ্ডলে অবস্থাকালে দেবীর পুজো করেছিলেন, সে-কথাও এখান থেকে জানা যায়। জানা যায়, স্বয়ং শিবও দেবীর পুজো করেছিলেন। ত্রিপুরাসুরকে বধ করার পূর্বে ত্রিপুর ধ্বংস করার মুহূর্তে দেবীর কৃপা প্রার্থনা করে।
'দেবী ভাগবত পুরাণ' থেকে জানা যায় যে, ভৃগু, বশিষ্ঠ, কশ্যপ, বিশ্বামিত্র প্রভৃতি ঋষিগণ রামচন্দ্রের মতোই নবরাত্রব্রত পালন করে দেবীর পুজো করতেন।
'ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ'-এর 'প্রকৃতি খন্ড'-এর সাতান্নতম অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, দেবী 'দুর্গ' নামক এক অসুরকে বধ করে 'দুর্গা' নামে আরাধ্যা হন। সেখানে 'দুর্গা' শব্দের অর্থ করা হয়েছে এই ভাবে:
'দ' অর্থে দৈত্যনাশিনী, 'উ' অর্থে বিঘ্ননাশিনী, 'র' অর্থে বালাই ও ব্যাধিনাশিনী, 'গ' অর্থে পাপনাশিনী, এবং 'আ' অর্থে ভয়নাশিনী।
তন্ত্র 'দুর্গা' শব্দের পুরাণকৃত অর্থটিই সম্যকভাবে গ্রহণ করেছেন। এবং আমরাও দেবীকে এই অর্থের ব্যঞ্জিত আধারেই 'মা' বলে ডাকি, তাঁর আরাধনা করি। তাঁকে প্রণাম করি, এই বলে যে:
'ওঁ সর্বমঙ্গলামঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়ণ নমোহস্ততে।।'