উৎসবের ঋতু

“শ্রাবণ মাসের পর থেকেই কালীঘাটের পটুয়াপাড়ার রাস্তা দিয়ে যখনই যাই, দেখি রাস্তার দু’পাশে কুমোরের আখড়ায় সার সার একমেটে দশভূজা দাঁড়িয়ে আছেন। মনটা তখনই কেমন যেন খুশি খুশি হয়ে ওঠে…”

লেখক লিখে চলেন। লেখা কখনও হয়ে ওঠে গদ্য নিবন্ধ, কখনও বদলে যায় চিত্রনাট্যে। কিন্তু দেবী মূর্তি বদলায় না। কান্তময়ী সেই মূর্তি পটো পাড়া থেকে উঠে আসে সিনেমার পর্দায়। কাশফুল ওড়ে। আসে পুজোর চিঠি। ঘরে ফেরে প্রবাসী মানুষ, আত্মীয় স্বজন। শুরু হয় উৎসব। উৎসব ঋতুপর্ণেরও। পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের। 

ezgif.com-gif-maker (18)

১৯৯২ সালে বানালেন ‘হীরের আংটি’। চিল্ড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটি নিবেদিত, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের রহস্য উপন্যাস নিয়ে ছবি। ছবির প্রেক্ষাপট দুর্গাপুজো। ছবির শুরুতেই জমিদার বাড়িতে ডাকাত পড়ার দৃশ্য। গা ছমছম করে ওঠে। ডাকাত দেখতে দেখতে সেই ডাকাত কখন যেন হয়ে ওঠে ছাপোষা এক মানুষ। জেগে জেগে ডাকাতির স্বপ্ন দেখছিল সে। তারপরই শুরু হয়ে যায় পুজোর পরিকল্পনা।

জমিদার বাড়ির নাট মন্দিরে একচালার মেটে ঠাকুর। গায়ে পড়েছে রঙের পোঁচ। ঢাকিরা এসে পড়বে। মায়ের পুজোর আয়োজন নিয়ে চিন্তায় বাড়ির কর্তা। সেবার ৩০ বছরে পড়ল। নদীর চরে কাশফুল ফোটে। হাওয়ায় দুলতে থাকা সাদা ফুলের গায়ে আগমনীর চিঠি। মনের মধ্যে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসে দূর থেকে। খুব মন কেমন করে। দেশের প্রতি। মাটির প্রতি। দুর্গা পুজো তখন আর শুধুমাত্র পার্বণ থাকে না। ছবিও শুধুমাত্র আর ‘ছবি’ থাকে না দর্শকের কাছে। বরং তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু।

ezgif.com-gif-maker (17)

ফের কলম তুলে নেন ঋতুপর্ণ, লেখেন, “ তারপর একদিন শ্রাবণের মেঘ কেটে যায়, মাটির শরীরগুলো সাদা হয়ে যেন কাশসুন্দরীর মতো দেখায়...মনে হয় পশ্চিমের যে কোনও দেশের কিউরেটরকে এনে দেখাই, বলি যে, ‘পারবে তোমরা এমন গোটা একটা পাড়া জুড়ে মাটির ঢেলাকে রক্তমাংসের করতে, আর রক্ত মাংসের শরীরকে অমন মায়াবী করে শিল্পের চেহারা দিতে?”

বছর ঘুরে ঘরে আসে দেবী দুর্গা। বাঙালির কাছে সে ঘরের মেয়ে দুগগা। ঋতুপর্ণ যেন সেভাবেই উৎসবকে দেখাতে চেয়েছেন তাঁর ছবিতে। একেবারে আম বাঙালির উৎসব। এই উৎসবে জাঁক নেই, আছে স্নিগ্ধতা। পুজো ঘিরে টানাপোড়েন, পরিবার-সম্পর্কের জটিলতা সবই আছে কিন্তু সেসবকে ছাপিয়ে যায় উৎসবের আমেজ। বড় যত্ন করে নিজের ছবিতে দুর্গা পুজোর আবহ গড়ে তুলেছিলেন তিনি।

২০০০ সালে তৈরী করলেন ‘উৎসব’। এবারও ছবির কাহিনি ঘুরেছে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে। উৎসবের প্রেক্ষাপটে এক পরিবারের গল্প। ছবির কেন্দ্রে একটি বাড়ি। সেই বাড়ির সর্বময় কর্তী ভগবতী। তাঁর দুই ছেলে আর দুই মেয়ে। বনেদি বাড়ির পুজো আত্মীয় স্বজন, বন্ধু, চেনা পরিচিতদের ভিড়ে জমজমাট। তার মধ্যেই চোরাগোপ্তাভাবে চলছে বাড়ি বিক্রির পরিকল্পনা। পঞ্চমীর সকালে শুরু হয় ছবি, দশমী-একাদশী হয়ে গড়ায় কালীপুজো পর্যন্ত। ‘উৎসব’ ছবিতেও একচালার সাবেকি গড়নের দুর্গা। একচালা যেন একান্নবর্তী পরিবারের প্রতীক। তারা এক হয়েও বিচ্ছিন্ন, আবার বিচ্ছিন্ন হয়েও এক। মূল চরিত্রও পাঁচটি। তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা, টানাপোড়েন নিয়ে এগিয়েছে ছবি। গিয়ে মিশেছে একটি মূল দিকে। বাড়ি বিক্রির টাকা ঢেকে দেবে তাদের সংকট। সমাধান এনে দেবে জীবনে।

২০০৫ সালে নির্মাণ করেন অন্তরমহল। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘প্রতিমা’ অবলম্বনে নির্মিত ছবি। অভিষেক বচ্চন, সোহা আলি খান, জ্যাকি শ্রফ, রূপা গঙ্গোপাধ্যায় মূল চরিত্রে। সেই ছবির কাঠামো নির্মিত হয়েছে দুর্গাপুজোর গল্পে। সামন্ততান্ত্রিক জমিদার পরিবার। সময়কাল ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ। এই কাহিনীর কেন্দ্রে ভুবনেশ্বর চৌধুরী।   তিনি ব্রিটিশদের তোষামোদ করে রায়বাহাদুর খেতাব পাওয়ার আশা করেছিলেন। কিন্তু রায়বাহাদুর হওয়ার রাস্তাটি মসৃন ছিল না। বেশ কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল তাঁর। তাই তিনি চমক দিতে চাইলেন। ভুবনেশ্বর পরিকল্পনা করলেন তাঁর বাড়ির যে দেবী দুর্গার মুখের আদল হবে রানী ভিক্টোরিয়ার মুখের মতো।

অন্যদিকে, তিনি একজন উত্তরাধিকারী চান। প্রথমা স্ত্রী মহমায়া গর্ভধারনে ব্যর্থ হলে ভুবনেশ্বর ১২ বছর পর দ্বিতীয়বার দ্বারপরিগ্রহ করলেন। দ্বিতীয়া স্ত্রী যশোমতী। জমিদার বাড়ির ছোট বউ। কীভাবে বাড়িতে প্রতিমা গড়তে আসা তরুণ ভাস্করের হাতে দুর্গা প্রতিমার মুখের আদল মিলে যায় বাড়ির ছোট বউয়ের মুখ।

ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতে ঘুরে ফিরে এসেছে উৎসব। পর্দার বাইরের দুনিয়ায় দুর্গাপুজোর ছবি বদলে গেলেই বাঙালির চেনা শারদোৎসব তাঁর ছবিতে সব সময়েই আটপৌরে সাজে সেজে উঠত। ঠিক যেভাবে শরৎ এলে তাঁর চলাচলের পথে একটু একটু করে বদলে যেতে দেখতেন শহরটাকে, ঠিক সেভাবেই।

খড়ের কাঠামো থেকে মেটে প্রতিমা। প্রতিমার গায়ে শিউলি রঙের ছোঁয়া। অঙ্গ ঝলমলিয়ে উঠত সাটিন শাড়ির রঙ্গে। মাথায় গায়ে শোলার সাজ। টানা টানা চোখে চিন্ময়ী মা হয়ে উঠতেন মৃন্ময়ী বারবার…

ছবি বদলাতো। চরিত্র বদলাতো। নাট মন্দির বদলাতো, শুধু বদলাত না দুর্গার মুখ…সেই দেবীকেই তিনি সন্মৎসর ঘরে ফেরার কালে কানে কানে জিজ্ঞেস করতেন…কী গো কেমন আছ?

ঋতুপর্ণের দুর্গা শরতের আনন্দী কন্যা। তাকে দেখে ঘরে ফেরার টান জাগে…মনে হয় এই বুঝি মা জেগে আছে…হলেই বা ক্যামেরায়, সেখানেই তাঁর আসল উৎসব…ঋতু-উৎসব…

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...