বাংলা ও বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব হল দুর্গা পুজো। সারা বছর বাঙালি অপেক্ষা করে ঐ চারটি দিনের জন্য, ৩৬৫ দিনের এক দীর্ঘকালকে বাঙালি একটি বাক্যেই উড়িয়ে দিতে পারে, "পুজো আসছে তো!"। এই "পুজো আসছে"কে ঘিরেই আমাদের সব কিছু, আমাদের প্ল্যানিং, হই-হুল্লোড়, খাওয়া-দাওয়ার সব জম্পেশ প্ল্যান। জামা কাপড় কেনা, রাত জেগে ঠাকুর দেখা, প্যান্ডেল হপিং, সত্যিই পুজো মানেই যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পাওয়া। ব্যস্ত বাঙালি পৃথিবীর যেখানেই থাকুক এই সময়তে সে বাড়ি আসবেই। বন্ধুদের সাথে দেখা হওয়া, দেখা হওয়ায় পরিকল্পনায় হোয়াটস্যাপ গ্রুপ বানানো, রোল-ফুচকা-আইসক্রীমে ডায়েটকে কদিনের জন্য টাটা বাই বাই করা, মানেই তো পুজো।
বনেদি বাড়ির পুজো থেকে ম্যাডাক্সের আড্ডা, তিলোত্তমা সেজে ওঠে পুজোয়। গ্রাম থেকে মফস্বল সর্বত্র আলোয় আলোয় আলোকিত হয়। মা আসেন, আপদবালাই দূরে করে সুখ সমৃদ্ধির প্রার্থনা করি আমরা। মহালয়ার ভোরে বীরুপাক্ষের কণ্ঠে স্তোত্রপাঠ, সপ্তমীর কলাবউ স্নান, অষ্টমীর অঞ্জলি, নবমী ভোগ আর সিঁদুর রাঙা দশমীর বিরহ, এটাই আমাদের রসদ। এইটুকু সম্বলকে বুকে করে নিয়ে আমতলা থেকে আর্মস্টার্ডাম পাড়ি দেয় বাঙালি। পয়লা বৈশাখে হলখাতার ক্যালেন্ডার পেয়েই বাঙালি দেখে নেয় পুজোর দিনগুলো, ব্যস শুরু হল পরিকল্পনা, রথ এলেই মনটা কাউন্টডাউন শুরু করে। এই বিশ্বে আর একটাও এমন জাত আছে, যারা কেবল এমন একটি উৎসবকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকে। বাঙালিকে একমাত্র দুর্গা পুজো দিয়েই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। বাংলা ও বাঙালির সমার্থক এই দুগ্গা পুজো। এবার সেই পুজোই স্থান পেল বিশ্বের দরবারে। মিলল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
ইউনেস্কোর 'রিপ্রেজেন্টেটিভ লিস্ট অফ ইনট্যান্জিবেল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি'-এর তালিকায় নবতম সংযোজন হল বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব, দুর্গোৎসব। প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ১৬তম অধিবেশনে এই সংযোজন করা হয়েছে। গতকালই এই খবর সামনে এসেছে। বাংলা ও বাঙালির গর্বের দিনের তালিকায় ১৫ই ডিসেম্বর দিনটিও জুড়ে গেল।
এবছর সেপ্টেম্বর মাসে দুর্গাপুজোকে আন্তর্জাতিক উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ইউনেস্কোর কাছে আবেদন জানিয়েছিল রাজ্য সরকারের পর্যটন দপ্তর। দু-বছর আগে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবকে মেগা ফেস্টিভালের স্বীকৃতি দিয়েছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল। বাংলার দুর্গোৎসবের ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাঙালিদের এক অনন্য প্রাপ্তি।
চলতি বছর দুর্গা পুজোর প্রায় ২ মাস আগে থেকেই দুর্গোৎসবকে আন্তর্জাতিক উৎসবের স্বীকৃতি দেওযার জন্য, ফের ইউনেস্কোর কাছে আবেদন জানায়েছিল রাজ্যের পর্যটন দপ্তর। পুজো মানেই বাঁধন হারা আনন্দ, সেই সঙ্গে পুজো বহু মানুষের রুজি-রুটি যোগায়। দুর্গাপুজো প্রায় ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকার উৎসব। এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু মানুষের জীবন-জীবিকা। বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষ সারা বছর এই উৎসবের দিকেই তাকিয়ে থাকেন। এই সময়ই বহু মানুষ লাভের মুখ দেখেন। এই উৎসব সংক্রান্ত যাবতীয় চিত্র রাজ্য সরকার ইউনেস্কোর সামনে তুলে ধরে। দুর্গাপুজোকে ঘিরে রাজ্য সরকার একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করে ইউনেস্কোতে পাঠিয়েছিল। এবার তারই স্বীকৃতি এল।
এইভাবেই বেঁচে থাক বাংলা ও বাঙালির আবেগ! পুজো আসছে আর পুজো আসবের প্রতীক্ষার মধ্যে অক্ষত থাক বাঙালিরা।