Durga Puja Bijaya: আগমনে যেমন গান আছে, তেমন বিসর্জনেও রয়েছে গান

আগমনে যেমন গান আছে, তেমন বিসর্জনেও রয়েছে গান। রীতি-রেওয়াজ হিসেবেই রয়েছে। প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে ফেরার পথে বাড়ির ছেলেরা 'বঙ্গ আমার জননী আমার' গানটি গাইতে গাইতে ফেরেন। কোন বাড়িতে হয় এ জিনিস? অষ্টাদশ শতকের একেবারে আন্দুলের দত্ত চৌধুরীদের ছেলে রামচন্দ্র দত্ত হাটখোলা অঞ্চলে বাড়ি গড়ে শুরু করেন দুর্গোৎসব। রামচন্দ্রের পৌত্র জগৎরাম দত্ত নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে আরেকটি বাড়ি করে ১৭৯৪ সালে সেখানেও আরাধনা শুরু করেন। জগৎরাম ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পাটনার দেওয়ান। এ বাড়ির দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন শেষে বাড়ির ছেলেরা সমবেতভাবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানটি গাইতে গাইতে বাড়ি ফেরেন। পরিবারের কোনও এক পূর্বপুরুষ প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় গানটি গাওয়ার প্রচলন করেছিলেন। আজও সেই রীতি চলছে।

vijaya dashami

তন্ত্রসাধক মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে মন্মথঠাকুরের পুজোতেও দশমীতে বিসর্জনের পর গান গেয়ে ফেরার নিয়ম। পরিবারের সদস্যরা শ্রীমন্মথঠাকুরের লেখা ভক্তিসঙ্গীত দীন দুঃখ হরা গান গেয়ে ঘরে ফেরেন।

আবার বিসর্জন দিতে যাওয়ার আগে গানের নজিরও রয়েছে। চোরবাগানের চট্টোপাধ্যায় পরিবারেই এমনটা হয়। রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী দুর্গাদাসীর পরামর্শে এ বাড়িতে ১৮৬০ সালে প্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়। দশমীতে উমাকে বাড়ি পাঠানোর আগে চট্টোপাধ্যায়রা সব্বাই মিলে একসঙ্গে গান ধরেন। 'ভজিতে তোমারে শিখি নাই কভু, ডাকি শুধু তোমায় মা বলে। সাধনার রীতি জানি নাকো নীতি, পুজি শুধু তোমায় আঁখি জলে।' গান গেয়ে মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন পরিবারের লোকজন। আর্তি থাকে দেবী যেন তাঁদের ভুলত্রুটি মার্জনা করেন। তারপর নিরঞ্জনের জন্য রওনা হওয়া হয়।

এবার বলি বিসর্জনের বোলের জন্ম কথা।
ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ...
ঠাকুর যাবে বিসর্জন। এ ঢাকের বোলের সব্বার চেনা।

শোভাবাজার চত্বরের কয়েক পুরুষের বড়লোক দত্তদের বসবাস ছিল। দত্তবাড়ির চূড়ামণি দত্ত বিসর্জনের বোলের জন্ম দিয়েছেন। চূড়ামণি ছিলেন ধনী, দানবীর কিন্তু অর্থের অহং ছিল। পৃথিবী শুদ্ধু লোকদের শালা বলে ডাকতেন। চাকর-বাকরদের অভাব ছিল না। পয়সা থাকলে মানুষ এমনিতেই ফুটতে থাকে, সে'যুগ হোক আর এ'যুগ ধনীর এ জিনিস থাকেই।

চূড়ামণি দত্ত নিজের পাল্কি করেই নিজের অফিসে যাতায়াত করতেন। একদিন অফিস গেছেন। লেখার জন্য খাগের কলম কাটতে শুরু করলেন। বেখেয়ালে তাঁর আঙুল কেটে রক্তপাত হল। চূড়ামণি দত্ত লাফিয়ে উঠলেন। কর্মচারীদের হুকুম দিলেন শিগগিরি বেহারা ডাকতে। বাড়ি যাবেন। চূড়ামণির দেহ থেকে প্রথম রক্তপাত হল। আর সময় নেই বলতে বলতে পাল্কিতে চড়ে বসলেন।

বাড়ি ফিরেই দেওয়ানকে হাঁক দিলেন। খবর পেয়েই দেওয়ান এসে হাজির। হুকুম হল, একশো জন ঢাকি চাই। বিনা বাক্য ব্যয়ে ঢাকি জোগাড় করে ফেললো দেওয়ান। এবার হুকুম, খাটে বিছানা পেতে দিতে হবে। গরদের কাপড় পরে, মাথায় নামাবলী জড়িয়ে খাটে উঠে পড়লেন। নিজের গায়ে মাথায় দুর্গা, কালী, রাম, হরির নাম লিখে দিতে হুকুম দিলেন। ঢাকিদের উদ্দেশ্যে হাঁক পেড়ে বললেন, বিসর্জনের বাজনা বাজানো যাবে না। নয়া বোল বাতলে দিলেন। বললেন, এই বোলে তাল দিয়ে বাজাবি। বোল দিলেন,

'দুনিয়া জিনিয়া চূড়া
যম জিনিতে যায়,
তোরা দেখবি যদি আয়।
যম জিনিতে যায় রে চূড়া
যম জিনিতে যায়।'

চূড়ামণির খাট উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল একশো ঢাক। ঢাক বাজচ্ছে, চূড়ামণি হাততালি দিতে দিতে গাইছেন, ‘যম জিনিতে যায় রে চূড়া, যম জিনিতে যায়’। যাওয়ার পথে চূড়ো শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণকেও আওয়াজ দিয়ে গেলেন।
শোভাযাত্রা গঙ্গার ঘাটে গিয়ে পৌঁছল, সন্ধ্যা হয়ে গেছে ততক্ষণে। চূড়োর জীবনেও সন্ধ্যা নেমে আসবে আসবে করছে। গঙ্গাতীর লোকে লোকারণ্য। চূড়ো আদেশ দিলেন, খাট সমেত জলে নামাও। জলে নামিয়ে ধ্বনি দিতে লাগল, ‘গঙ্গা নারায়ণ ব্রহ্ম’। চূড়ো গঙ্গাজল মাথায় দিয়ে বললেন, এস যম, তোমার আজ পরাজয়। তারপরই চূড়ামণির ভবের খেলা সাঙ্গ হল। গঙ্গাতীরে জয়ধ্বনি উঠল, জয় যম-বিজয়ী চূড়ামণি দত্তের জয়! বিসর্জনের বাজনার নতুন বোলের জন্ম হল। এই তালেই বিসর্জনের বাজনা বাজে। ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ... ঠাকুর যাবে বিসর্জন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...