পুজো মানে পুজোর গান

"সেদিন ভোরে দেখি উঠে / বৃষ্টিবাদল গেছে ছুটে / রোদ উঠেছে ঝিলমিলিয়ে
বাঁশের ডালে ডালে / ছুটির দিনে কেমন সুরে / পুজোর সানাই বাজছে দূরে"

 

সানাই শুধু বিয়েতেই বাজে না, পুজোতেও বাজে। দুর্গাপুজোর এখনও বেশ কিছুদিন দেরি আছে বটে। কিন্তু একটু কান পেতে শুনুন, আমাদের মনের অন্তরালেও কিন্তু পুজোর সানাই আর পুজোর গান বাজতে শুরু করে দিয়েছে। এখনকার পুজো বলতে যা কিছু বোঝায় সেগুলোকে একটু দূরে সরিয়ে রেখে আমরা বরং কয়েক বছর একটু পিছিয়ে যাই।

 

‘প্যান্ডেল হপিং’ বা ‘থিম পুজো’ শব্দগুলো তখনও বাঙালির ডিকশনারিতে জায়গা পায়নি। মুঠোফোনের দৌলতে তখনও পর্যন্ত লোকজনের মাথা হেঁট হয়নি। সেকালে নির্দিষ্ট দিনের অনেক আগে থেকেই কিন্তু বাঙালির দুর্গাপুজো শুরু হয়ে যেত। পুজো মানে কি শুধুই পুজো! তার সঙ্গে আরও অনেক কিছু। প্রদীপ জ্বালানোর আগে যেমন সলতে পাকানো হয়, তেমনি দুর্গাপুজো শুরু হবার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই কয়েকটি উপকরণ দুর্গা পুজোর আবহ তৈরি করে দিত।

 

তাদের মধ্যে অন্যতম হল পুজোর গান। দোকানে দোকানে লাইন পড়ে যেত। কেউ আগাম টাকা দিয়ে রাখত যাতে না স্টক
ফুরিয়ে যায়। সারাবছর ধরে অপেক্ষা করার পর সেই ক্যাসেট হাতে আসত। আসলে তখন জীবনে বিনোদনের এত প্রাচুর্য ছিল না বলেই সবটুকু সে রসে বশে গ্রহণ করত।

 

কিন্তু পুজো সংখ্যার মতো পুজোর গান কেমন ভাবে অপরিহার্য হয়ে উঠল বাঙালির জীবনে! কেমন ছিল সেই বিবর্তনের দিনগুলো! চলুন একটু উঁকি মারা যাক সেই ফেলে আসা দিনের দিকে।

pujorgaan1

সময়টা ১৯১৪। সেইসময় থেকেই পুজোর গানের একটা রেওয়াজ শুরু হয়। যদিও ‘পুজোর গান’ এই নামে সেগুলো বেরত না। সেইবছর গ্রামোফোন কোম্পানি ‘শারদীয়া’ নাম দিয়ে ১৭ টি রেকর্ড বার করে। কিন্তু তখন কোনও গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা
প্রকাশ্যে গান বাজনা করতেন না। সেই সময় সঙ্গীতের জগতে একাধিপত্য ছিল বিভিন্ন বাইজীর। তাই এই রেকর্ডে গান ছিল মানদা সুন্দরী, বেদানা দাসী প্রমুখ খ্যাতনামা বাইজিদের। পুরুষকন্ঠে ছিলেন কে মল্লিক, নারায়ণ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। এঁদের গাওয়া কীর্তন, আগমনীবিজয়ার গান যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।

 

তবে এই সময় অন্যতম একজন সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ছোটবোন অমলা দাশ। তিনি ‘শারদীয়া’ রেকর্ডে গেয়েছিলেন দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। এই বিপুল জনপ্রিয়তার ফলে পুজোয় গানের ক্যাসেট বের করা রীতিমতো একটা প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই কোম্পানিগুলির কাছে।

 

কিন্তু বাংলা সঙ্গীত জগৎ সেই সময় একটু একটু করে স্বাভাবিক নিয়মেই পরিবর্তিত হচ্ছিল। কীর্তন, আগমনী বিজয়া ছেড়ে বাংলা গান বাঁক নিল আধুনিক গানের জগতে। এই সময় থেকে বাংলা সঙ্গীত জগৎ পেতে শুরু করল একঝাঁক গুণী শিল্পীকে। কে এল সায়গল, গৌরীকেদার ভট্টাচার্য, কৃষ্ণচন্দ্র দের মতো শিল্পীকে।

 

সেইসময় গানের রেকর্ড বিক্রি বাড়াবার জন্য গ্রামোফোন কোম্পানি ‘শারদীয়া’ নামে একটা ছোট্ট পুস্তিকা বার করত যা গানের ক্যাসেটের সঙ্গে বিনামূল্যে দেওয়া হত। গ্রামোফোন কোম্পানির পাশাপাশি এই সময়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে এইচএমভি কোম্পানির। বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী যূথিকা রায়ের গান দিয়েই পুজোর গান জনপ্রিয়তা লাভ করে।

 

সালটা ১৯৪৯। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা অবলম্বনে সলিল চৌধুরীর সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইলেন ‘রানার’। বাংলা সঙ্গীত জগৎ তো বটেই, স্বয়ং হেমন্তের জীবনেও এই গানটি একটি মাইলস্টোন। শহর থেকে গ্রাম থেকে মফঃস্বল - সব জায়গাতেই এই গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এইসময় আরও এক নক্ষত্রের উদয় হয়। তিনি মান্না দে। গৌরীপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের কথায় ও সুরে ‘হায় হায় গো রাত যায় গো’ এবং ‘আর কত দূরে নিয়ে যাবে বল’ গান দুটি গেয়ে জনপ্রিয়তার শিখর স্পর্শ করলেন মান্না দে।

pujorgaan2

১৯৫৭ র অস্থির সময়ে ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’ গাইলেন মানবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তারপর থেকে একের পর এক কালজয়ী গান তৈরি হতে থাকল কিংবদন্তি সব শিল্পীদের কণ্ঠে যার অনুরণন ও মূর্চ্ছনা আজও সমানভাবে রয়ে গেছে। যতই
নতুন গান তৈরী হোক কিশোরের সেই ‘একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে’ অথবা লতার ‘আমার মালতীলতা কী আবেশে দোলে’ কোনও পুজো প্যান্ডেলে বাজলে মনে হয় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনি। এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মনের কানায় কানায় পূর্ন হয়ে যায় এমনই মাধুর্য এইসব গানের। ‘একদিন পাখি উড়ে যাবে - এই গানটির মধ্যে দিয়েই রাহুল দেব বর্মণ কিশোরকে প্রথম পুজোর বাংলা গান গাওয়ালেন।

 

দুর্গাপুজোর পরই এইচএমভি কোম্পানি প্রকাশ করত শ্যামাসঙ্গীত পান্নালাল ভট্টাচার্য ও ধনঞ্জয়ের কণ্ঠে। এই গানগুলি কালীপুজোয় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এরপর হেমন্ত মুখার্জী ও শ্রাবন্তী মজুমদারের কণ্ঠে ‘আয় খুকু আয়’ গানে বাবা–মেয়ের চিরন্তন ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপনে গানটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হৈমন্তী শুক্লার ‘ময়ূর নাচে দেখবি আয়’ পর স্বপ্না চক্রবর্তীর ‘বড় লোকের বিটি লো’ গানটি তখন সব প্যাণ্ডেলে সুপারহিট গান ছিল।

 

আশির দশকে রেকর্ডের বদলে এল ক্যাসেট। সে এক সময় ছিল। এইসময় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমেডিও বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। তারপর একরাশ গানের পসরা সাজিয়ে এলেন কুমার শানু। তাঁর ‘সুরের রজনীগন্ধা’ বা ‘প্রিয়তমা’

 

অ্যালবামের গানগুলো না চললে যেন পুজোর আবহটাই তৈরী হয় না। ২০০২-২০০৩ নাগাদ এল সিডি, ডিভিডি। একই ছাতার তলায় দুশো তিনশো গান। তারপরের দ্রুত বদলে যাওয়া ইতিহাস তো সকলের জানা। দীর্ঘ এই সময়ে কতই না নামিদামি শিল্পীর
অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাংলা সঙ্গীতের জগতে। এখনও প্রতিদিন কত নতুন শিল্পীর জন্ম হচ্ছে। কিন্তু ক’জন তাদের মধ্যে মানুষের মনে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলতে পারছে। তারা আজ গাইছে, কাল হারিয়ে যাচ্ছে।

 

কাজেই আমাদের হাতে সেইসময় স্মার্টফোন আর দ্রুত বদলে যাওয়া সময়ের প্রাচুর্য ছিল না। তাই আমাদের কাছে পুজো মানে ছিল পুজো সংখ্যা। পুজো মানে পুজোর গান - যার জন্য সারা বছর সকলে উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষায় থাকত।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...